সদিচ্ছা থাকলে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলেও অনেক কিছু শেখানো যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা: শিক্ষক-শিক্ষিকারা ইচ্ছে করলে স্কুলেই যে অনেক কিছুই করে দেখাতে পারেন তা দাসপুর-১ ব্লকের সুলতাননগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো কয়েকটি স্কুল তার বাস্তব উদাহরণ।

ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করার জন্য বিদ্যালয় যায়, এটা নিয়ে তো বলার কিছু নেই। কিন্তু পড়াশোনার বাইরেও যে স্কুল থেকেই অনেক কিছু শেখা যায় সেই সংস্কৃতি বর্তমানে রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলেই নেই। বিভিন্ন ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, সুলতাননগর প্রাথমিক বিদ্যালয় কিন্তু তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এই বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি শিক্ষক-শিক্ষিকাই ছাত্রছাত্রী নিবেদিত প্রাণ। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বিষয়টি ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের বিকাশের জন্য প্রতিনিয়ত একটা না একটা পরিকল্পনা নিয়েই চলেছেন।
কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। স্কুলের প্রার্থনা দিয়েই শুরু করা যাক। প্রতিদিনই হারমোনিয়াম সহযোগে প্রার্থনা সঙ্গীত, জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে প্রার্থনা শুরু হয়। ছাত্রছাত্রীদের সাধারণ জ্ঞান সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়াতে ওই সময়েই সংবাদ পরিবেশনে ব্যবস্থা থাকে। পড়ুয়ারাই এলাকার খবর পড়ে। প্রার্থনা সভায় শিশুদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে চকোলেট দেওয়া হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বঙ্কিম মাজি বলেন, স্কুলে পড়ুয়ারা ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্ম তারিখ নিয়ে একটি সুদৃশ্য ‘জন্মদিনের ক্যালেন্ডার’ স্কুলে তৈরি করা হয় প্রতিবছর। আগে থেকে দেখে রাখা হয় কবে কার জন্ম দিন। এটি শিশুদের মধ্যে অন্য অনুভূতির সৃষ্টি করে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, সহশিক্ষিকা অপর্ণা বারিক ও সহশিক্ষক দিলীপকুমার দোলই শিশুদের নিয়মিত গানের তালিম দিয়ে থাকেন। মিড ডে মিলের মেনুতে বৈচিত্র্য রাখার চেষ্টা করা হয়। মিড ডে মিল খাওয়ার সময় মিউজিক সিস্টেমে গান শোনানোর ব্যবস্থা আছে। নিয়মিত ব্রতচারী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দিলীপবাবু ব্রতচারীর মূল প্রশিক্ষক। তিনি নিজের স্কুল ছাড়াও পাশাপাশি বিদ্যালয়ে ব্রতচারীর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ছাত্রছাত্রীদের নাটক প্রশিক্ষণ দেন সহশিক্ষিকা সোমা কুলভী। শিশুদের সাহিত্য চর্চা অভ্যেসের জন্য নিয়মিত ছড়া, কবিতা লেখানোর অভ্যেস করা হয়। ওই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের লেখা কবিতা রাজ্যস্তরের পত্রিকাতেও স্থান পেয়েছে। সুদৃশ্য আর্ট গ্যালারি ও ফটো গ্যালারি আছে বিদ্যালয়ে। পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত জীবিত কবি ও লেখকের সাথে ফোনে কথা বলানো হয়। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিশেষত আবৃত্তি বিভাগে এই স্কুলের বাচ্চারা খুব পারদর্শী। ওই স্কুলের দুই পড়ুয়ার দুই অভিভাবিকা কাজলী মণ্ডল এবং বর্ণালী মাইতি বলেন, ছাত্রছাত্রীদের সাথে শিক্ষক-শিক্ষিকারা এমন ভাবে মেশেন তাই অনেক দিন স্কুল ছুটি থাকলে ছেলে-মেয়েদের বাড়িতে মন বসে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে এতকিছু দরদ দিয়ে করানো হয়, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে বৈকি! ছাত্রছাত্রীদের মানসিক বিকাশের সমস্ত রসদ স্কুলটিতে পাওয়া যায় বলেই ওই স্কুলের খুদে পড়ুয়ারা কখনই বোরিং হয় না। আর স্কুলে পাঠিয়ে বাবা-মায়েদের কোনও টেনশন করতে হয় না।
‘অ্যাই তোরা গণ্ডগোল করবি না, মন দিয়ে পড়…’ এই ধরনের উপদেশ দিয়ে রাজ্যের সরকার পোষিত অধিকাংশ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা যখন অফিস রুমে বসে আড্ডা দেন কিম্বা স্মার্ট ফোন খুলে মুচকি হাসতে হাসতে হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকের চ্যাট করেন বা হয়তো টেবিলে মাথাগুঁজে ভাতঘুম সেরে নেন সেই সময় সুলতাননগর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছাত্রছাত্রীদের পড়ুয়াদের নিয়ে সমাজ, বিজ্ঞান, পরিবেশ সচেতনতা মূলক গল্প করেন। শিখিয়ে দেন, স্কুলের বাইরের কথাবার্তা, আচরণ কেমন হবে।ওই স্কুলের দুই সহকারী শিক্ষক কেশব মেট্যা এবং মুক্তি মান্না বলেন, পড়ুয়াদের আরও সমৃদ্ধ করতে মাঝে মাঝেই বিশেষজ্ঞদের দিয়ে জন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান যেমন ‘সাপের কামড় ও তার প্রতিকার’, ‘ডেঙ্গু জ্বর ও তার প্রতিকার’ বিষয়ক অনুষ্ঠানও করা হয়। ওই স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্রী তথা বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্রী পূর্বা ঘোষ এবং এক প্রাক্তন ছাত্র তথা পাঁচবেড়িয়া হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষক সন্দীপ ঘোষ বলেন, সুলতাননগর প্রাথমিক স্কুল বরাবরই ব্যাতিক্রমী ছিল। আর পাঁচটা স্কুলের থেকে অনেক বেশি কালচারাল। সব দিক থেকেই এই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা এগিয়ে। সন্দীপবাবু বলেন, ঠিক করেছি আমার সন্তানকেও এখানেই পড়াব।
১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলটি অনুমোদন পায় ১৯৬৭ সালে। বর্তমানে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১৩১। গতানুগতিক পঠন পাঠনের বাইরে বেরিয়ে কিছু নতুন করার প্রয়াস বরাবরই যে দেখিয়ে থাকে তা প্রশাসনের মহলেও অনেকে জানেন। দাসপুরের বিধায়ক মমতা ভুঁইঞা বলেন, সুলতাননগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুনামের কথা শুনেছি। সত্যিই ওখানের শিক্ষক-শিক্ষিকারা অন্যভাবে পড়ুয়াদের নিয়ে ভাবেন।
১৬ জুলাই থেকে নতুন একটি বিষয় শেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় ওই স্কুলে। সেটা হল সাংবাদিকতার পাঠ শেখানোর উদ্যোগ। প্রধান শিক্ষক বলেন, আমরা কিছুদিন আগে থেকেই প্রত্যেক দিন প্রার্থনার সময় এলাকার কোথায় কী ঘটেছে তা পড়ুয়াদের কাছ থেকে সংবাদের মতো করে শুনতে চাইতাম। এদিন থেকে সংবাদ পরিবেশনের নিয়মানুযায়ী কী করে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে তার ব্যাকরণ শেখানো শুরু হয়েছে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই তা শেখাবেন। সেজন্য ওই দিন স্কুলে সংবাদের একটি কোলাজও করা হয়। যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ঘাটাল মহকুমার একটি জনপ্রিয় পাক্ষিক সংবাদপত্রের সম্পাদক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের লিঙ্ক: https://www.youtube.com/watch?v=53mjI5XzID0&feature=youtu.be

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!