চন্দ্রকোণা: নিজেদের মধ্য থেকেই আগুন লাগানোর কাজ করে ‘ভৌতিক’ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হত

দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়:লাহিরগঞ্জ, নামটা বেশ চেনা চেনা লাগছে না? ঠিক ধরেছেন! গ্রামটি চন্দ্রকোণা-২ ব্লকের ভগবন্তপুর-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। যেখানে গত ২৯ জুন শনিবার থেকে নাকি কেবল দিনের বেলায় অলৌকিক এক ‘ভূতুড়ে আগুন’ রুইদাস পাড়ায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাহলে একটু খুলেই বলা যাক। ৪ জুলাই সন্ধ্যা ৭টার সময় ঘাটালের মহকুমা শাসক অসীম পালের কাছ থেকে হঠাৎ ফোন আসে। বিষয়, ওই লাহিরগঞ্জ। তিনি বলেন, লাহিরগঞ্জে ভূতুড়ে আগুনের রহস্য ফাঁস করতে হবে। আমি তো হঠাৎ ভূতের দেখা পাবার উত্তেজনায় শিহরিত হয়ে মহকুমা শাসকের প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। আমরাও চাই সত্য উদঘাটিত হোক। পরের দিন ৫ জুলাই আমার সঙ্গী তাপস কর্মকার, চন্দ্রকোণা-২ ব্লকের জয়েন্ট বিডিও অনীক নন্দী, ওই ব্লকের পঞ্চায়েত উন্নয়ন অফিসার এবং পৃথক একটি গাড়ি নিয়ে চন্দ্রকোণা থানার ওসি প্রশান্তকুমার পাঠক রওনা দিই লাহিরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে যেতে যেতে ফোনে খবর এল আবার আগুন লেগেছে। আমরা শুধু স্বগতোক্তি করলাম আমরা পৌঁছালে ভূত পালাবেই। বেলা ১১টা ২০মিনিটে লাহিরগঞ্জ পৌছালাম। চারপাশে উৎসুক মানুষ।ওই টুকু জায়গাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্তত ২০০-২৫০ হবে। সব্বার চোখে মুখে একরাশ কৌতূহল। দেখলাম, একটি সদ্য পোড়া ছোট্ট কাঁথা। ধার দিয়ে এঁকেবেঁকে পুড়েছে। বাকীটা একদম অক্ষত। একজন পোড়ার ভিডিওটা দেখালেন। প্রতিবেশীদের কাছে আসল ঘটনা জানতে চাইলাম। জানলাম মধুসূদন রুইদাসের বাড়িতে অলৌকিকভাবে এই আগুন লাগা শুরু। জানলায় রাখা একটি সাদা রঙের ওড়না আগুনে পুড়েছে। এখন অভিজ্ঞতা বলে, সত্যানুসন্ধান এ কখনোই আগে থেকে কোনও স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে যেতে নেই। প্রত্যেক প্রত্যক্ষদর্শীর সমস্ত কথা যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়। কারণ দেখেছি অনেকেই গুরুত্বপাবার নেশায় নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে দাবি করে ঘটনাটি ঘেঁটে দেয়। লক্ষ্য করলাম মেয়ের ওড়নায় আগুন লাগার ক্ষেত্রে এখানে বাবা ও মেয়ে দুজনে দু’রকম কথা বলল। কথাগুলি নোট করলাম। শুনলাম ওরা ওঝা-গুণিন-তান্ত্রিক কিছুই বাদ দেননি ওই অলৌকিক আগুন নেভাতে। উক্ত ‘মহাপুরুষেরা’ অন্তত হাজার দশেক টাকা প্রণামী হিসাবে নিয়ে ঘোষণা করেছেন ওই আগুন লাগানোর কাজ এক ব্রহ্মদৈত্যর। যে নাকি রুইদাস বাড়িটি ওই জায়গায় অবস্থানের জন্য যাতায়াতের রাস্তা পাচ্ছে না বলে রেগে গিয়ে আগুন জ্বালছে। ফলশ্রুতিতে নামযজ্ঞ সমেত ধর্মের সব নিয়ম মেনে একটি মন্দিরও তৈরি হয়েছে, কিন্তু তবুও ব্রহ্মদৈত্যির রাগ একটুও কমছে না। তার যাতায়াতের রাস্তা করে দেবার জন্য ইতিমধ্যে বাথরুম ভাঙা হয়েছে দেখলাম। শুনছি নাকি ঘরগুলিও ভাঙা হতে পারে। ওদের অভিযোগ পেলাম যে এমনিতেই নাকি ওরা সরকারের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাচ্ছেন না। ইন্দিরা আবাস যোজনায় কোনও ঘর না পেয়ে ঝুপড়ির মতো ঘরে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। এখন যদি এই ঘরও চলে যায়,তবে ওরা থাকবে কোথায়!! আমি আচমকা জিজ্ঞেস করলাম, এত কিছুর (ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি) পরেও যখন আগুন জ্বলছে তার মানে, আর যাই হোক এটা ব্রহ্মদৈত্যির কাজ মোটেই নয়। তাহলে করছে কে? ওরা এটা শুনে একটু চমকে উঠল। কিছু না বলে বাকি আগুন লাগার ঘরগুলি দেখতে চাইলাম। দেখলাম বড় ছেলের বাচ্চা মেয়েটির পড়ার বই, জামা, ওড়না পুড়েছে। অন্যের খড়ের গাদা পুড়েছে। গোয়ালের চাল(এসবেস্টস) পুড়েছে। এমনকী চাবি লাগানো বাক্সের ভিতরে থাকা মূল্যবান দলিলপত্রও পুড়েছে। কী সাংঘাতিক ভূত! তাও আবার দিনের বেলায় পোড়াচ্ছে সব। রাতে কিন্তু একেবারে শান্ত! বেশ বেয়াড়া, বেয়াদব, বিদঘুটে ভূত তো! আলাদা আলাদা ভাবে ওই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে অনেক তথ্য পেলাম আমরা। জানলাম আগুন কম, ধোঁয়া বেশি,আর একটা কেমন উৎকট গন্ধ। আমার আর তাপসের মন খুশিতে ভরে গেল। মনে হচ্ছে যেন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। উজ্জ্বল আলো! জয়েন্ট বিডিও এবং ওসিকে দেখাতে চাইলাম। তাঁদের বললাম, আপনাদের কিছু দেখাতে চাই, তবে প্রকাশ্যে নয়। বন্ধ ঘরে। তবে একটা জিনিষ এনে দিতে হবে। জিনিসটা কী সেটা বললাম। প্রসঙ্গত, এর আগে আরও দুটো জিনিস আমাদের এনে দেওয়া হয়। সেটা পরীক্ষার সময় একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলে ওঠেন ঠিক একইরকম শিখা, ধোঁয়া ও গন্ধ! কিন্তু এমন অবস্থায় হঠাৎ জানতে পারি প্রথম আগুন লেগে যাওয়া জিনিষের পাশে আটটা দেশলাই কাঠি পাওয়া গিয়েছিল। তবে কী ভূত দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছে? তাজ্জব তো! তাছাড়া, জ্বলে যাওয়া জিনিসের মধ্যে কীসের একটা দাগ স্পষ্ট। তবে কি…! তাপস ঘাড় নাড়ল। সেই জিনিসটা ওসি এনে দিলেন। আর আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণ একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠল। মোটিভও অনেকটা স্পষ্ট। সম্ভাব্য জীবন্ত ভূতেদের মুখগুলোও চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। এটাই হবার সম্ভাবনা প্রবল। সবাই মেনে নিলেন। প্রশাসন আমাদের অনুরোধ করল এটা ওই দিন প্রকাশ্যে যেন আমরা না দেখাই। আমরা পরে একদিন ওই জায়গায় একটা কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠানের অনুরোধ করলাম। ১০জুলাই যথারীতি বিকেল ৩টায় ওই গ্রামে শুরু হল কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান ‘অলৌকিকের আড়ালে’। কিন্তু জন্ডিসের মালা ও জন্ডিস ধোয়া দেখিয়ে ব্যাখ্যা করার সময় নামল মুষলধারে বৃষ্টি। আধঘন্টা ধরে চলল বৃষ্টি। যখন ভাবলাম সব শেষ,তক্ষুনি বৃষ্টি থামল এবং ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় মহিলা পুরুষেরা পুরো ফাঁকা জায়গা ভরাট করে দিলেন। আমরাও একে একে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে দেখিয়ে যেতে লাগলাম পেট থেকে শেকড় তোলা, স্পন্দন বন্ধ, মিড ব্রেইন অ্যাক্টিভেশন, টেলিপ্যাথি,আগুন খাওয়া সমেত তাদের ব্যাখ্যা। এবার এলো সেই সন্ধিক্ষণ।আগুন ভূতের কার্যকলাপ ফাঁস। জনগণ দাবি তুলল, শুধু হাতে কলমে করে দেখিয়ে ব্যাখ্যা করাই নয়, তাদের জানাতে হবে এটা কে বা কারা করছে,আর কেনই বা করছে। প্রশাসনকে আগেই কথা দিয়েছি,তাই বিনয়ের সাথে জানালাম এ দায়িত্ব আমাদের নয়। এটা জানানোর দায়িত্ব পুলিশ প্রশাসনের। দেখালাম গ্লিসারিন আর পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের মিশ্রনে কেমন হঠাৎ করে আগুন জ্বলে যায়। কেউ মনে করলে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কঠিন পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের সামনে তরল গ্লিসারিন ঢেলে দিয়ে ঐ স্থান ছেড়ে কী করে সহজেই নিরাপদ স্থানে পালাতে পারে আর দাগিয়ে দিতে পারে আগুন লাগানোর কাজটি আসলেই ব্রহ্মদৈত্যির।তবে যেহেতু ঘটনাস্থলে দেশলাইকাঠি পাওয়া গেছে,তাই বিপথে পরিচালিত করতে চাইলে জুতো সেলাইয়ের পেশায় যুক্ত কোনও মানুষ জুতো জোড়া লাগানোর ‘রবার সলিউশন’ ব্যবহার করেও এটা করতে পারে। সে বা তারা যে জিনিসটাতে আগুন লাগাতে চায়,তাতে ওই ‘রবার সলিউশন’ টি লাগিয়ে ওই বস্তুটিতে আগুন ধরিয়ে দিলেও সেটি ওই একই ভাবে ধোঁয়া, আগুনের শিখা ও উৎকট গন্ধ তৈরি করে পুড়তে থাকবে ঠিক যেভাবে ওখানে ব্রহ্মদৈত্য সব কিছু পোড়াচ্ছে। তাছাড়া ওখানে ওই ‘রবার সলিউশন’ পাওয়াও খুব সোজা। আমরা প্রমাণ পেয়েছি। তাছাড়া যে যে ঘরে বিভিন্ন বস্তুতে আগুন লাগছিলো,সেই সেই ঘর আমরা ৪৮ ঘন্টা সিল করে দেবার পর কিন্তু ওখানে কোনও আগুনই জ্বলেনি। কিন্তু যখনই আবার ওই সব ঘর বাসিন্দারা ব্যবহার শুরু করল তখন আবার ব্রহ্মদৈত্য আগুন লাগাতেও শুরু করল। এবার আপনারা নিজেদের যুক্তিতে বুঝে নিন কীভাবে ওখানে আগুন লাগতে পারে। দর্শকদের সম্মিলিত হাততালিই আমাদের বুঝিয়ে দিল যে এই অনুষ্ঠানটি ও তার ব্যাখ্যা তাদের কতোটা মনঃপুত হয়েছে।আবার একবার বুঝলাম যুক্তিবাদের আলো কীভাবে অন্ধকার কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারে। আমরা নিশ্চিত যে এবার আগুন ভূতের বিদায়ঘন্টা বেজে গেল চিরতরে। এখন প্রশ্ন ভূতের অস্তিত্বই যেখানে অবান্তর, অবৈজ্ঞানিক, ভূতের আগুন লাগানোর কোনও প্রশ্নই নেই। লাগাচ্ছে মানুষ। তাই আপনারাও যদি এলাকায় গিয়ে সমস্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন সেক্ষেত্রে আপনাদেরও উপলব্ধি করতে বিন্দু মাত্র সময় লাগবে না কেন বা কীজন্য পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে বার বার ‘ভূতের’ গল্প ফাঁদা হয়েছিল। কিন্তু এটা যদি কোনও কারণে ফাঁস হয়, তবে জনতা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে। তাই প্রশাসনের অনুরোধেই নামটি প্রকাশ করা গেল না। •হিঁজড়ের উৎপাত রুখতে কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনে পাশে পেতে ‘৮৯২৭৭৯৩৬০০’এই নম্বরে ফোন করতে পারেন।

নিউজ ডেস্ক: ‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: ss.ghatal@gmail.com •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।