করোনা উত্তরকালে সমস্যাদীর্ণ শিক্ষায় আমাদের ভূমিকা

অভিজিৎকাপাস, রাজনগর[স্থানীয় সংবাদের পাঠক]:পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় দেখা গেছে ৯২% পড়ুয়া তাদের অর্জিত ভাষাজ্ঞান ভুলেছে এবং ৮২%পড়ুয়া সাধারণ যোগ বিয়োগ ভুলেছে।মাত্র ৭২০৪ জন পড়ুয়াদের নিয়ে এই সমীক্ষার ফল অঙ্কের উত্তরের ন্যায় অভ্রান্ত না হলেও, সমীক্ষা অভিমুখের ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। করোনা উত্তর কালে নিউ নর্মাল অবস্থায় জাতির জীবনে অশিক্ষার অভিশাপ নেমে আসবে।রাষ্ট্রকে আবার নতুন করে লড়াই শুরু করতে হবে অশিক্ষার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক তত্ত্ব বর্তমান কালে দাবি করে একটি রাষ্ট্রের অধিক জনসংখ্যা সমস্যা নয়,সমস্যা হলো অশিক্ষিত জনসমষ্টি। আঠারো মাস বা তারও বেশি সময় ধরে করোনার ছলনায় শিক্ষার সাথে আড়ি করে আমরা কি এক কদম এগিয়ে গেলাম না কি একশো কদম পিছিয়ে পড়লাম এই প্রশ্ন এখন অনেক সচেতন মনে উঁকি দিচ্ছে। একটা প্রজন্মকে আমরা অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত করলাম না তো। এরপর একটা প্রজন্ম খুঁড়িয়ে হাঁটলে বা হাঁটতে না পারলে আমরা পায়ের চিকিৎসা না করে, ক্র্যাচ ধরার এই প্রজন্মের হাতে।
এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে নিজেকে এই আমরা কে? এই আমরা যদি আমরাই হই ,তাহলে কাঁচের ঘরের দিকে ঢিল ছুঁড়ে কাজ নাই।করোনা উত্তর কালে শিক্ষার আকাশে যত কালো মেঘ দেখা দিবে ,যত দুর্যোগের ঘনঘটা সবুজ পৃথিবীকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার ইশারা করবে ,আমাদের সকলকে ততই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই দুর্যোগের মোকাবিলায় সামিল হতে হবে। দুটো কাজ খুব সহজ – সমালোচনা করা, অজুহাত দেওয়া। কোনোটাই কাজের নয়।বরং যা করতে হবে সেগুলিতে মনোনিবেশ করাই শ্রেয়। করোনাদীর্ণ শিক্ষার সব সমস্যা গুলিকে চিহ্নিত করতে হবে প্রথমে। তারপর সমস্যা অনুযায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।সমস্যা বিচিত্র হবে এবং দিন যত গড়াবে ততই সমস্যার দাঁত,নখ বেরিয়ে আসবে ।স্থান,কাল এবং অবশ্যই পাত্র ভেদে সমাধানের বিচিত্র রূপ আবিষ্কার করতে হবে। সমস্যা হরেক রকম হলে সমাধানও হাজার রকমের হবে না কেন?
শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্যার চিহ্নিতকরণ শিক্ষকদের দ্বারা সবথেকে ভাল সম্ভব। কারণ এই ক্ষেত্রটিকে তাঁরা তাঁদের নিজেদের হাতের তালুর মত চেনেন। তাই সর্বাগ্রে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে, মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের নিয়ে এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য অধ্যাপকদের নিয়ে পৃথক পৃথক কমিটি গঠন করা হোক।তাহলে সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের উপায় প্রকরণ অনেক সহজ হবে। সমস্যা দাঁড়িয়ে আছে স্কুল,কলেজের ক্যাম্পাস থেকে পড়ুয়াদের বাড়ি পর্যন্ত সর্বত্র। শিক্ষাঙ্গনের পরিকাঠামো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকার কারণে দীর্ণ হয়েছে।ল্যাব থেকে লাইব্রেরি, শ্রেণিকক্ষ থেকে স্মার্ট ক্লাসরুম অচল অধম হয়ে উঠেছে। এই সমস্যার সমাধান সরকারি বদান্যতা ছাড়া সম্ভব নয়। পরিকাঠামো ঘাটতির পূরণেই স্কুল,কলেজ খোলা যাবেনি।পরিকাঠামোর পরিধি বাড়িয়ে তুলতে হবে কোভিড প্রটোকল বজায় রাখতে।
সবথেকে বড় সমস্যার নাম শিক্ষার অসাম্য।করোনা পূর্ব অধ্যায়েও অসাম্য ছিল।কিন্তু এখন অসাম্য বেআব্রু হয়ে পড়েছে। হাতেগোনা কিছু অংশের অনেকটা এগিয়ে যাওয়া বৃহৎ অংশের পিছিয়ে পড়াকে প্রকট করবে।এখন এগিয়ে যাওয়া কোনও দোষের নয়। চরৈবেতি আমাদের ব্যক্তি জীবন,সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। কিন্তু ভাবনা ও ভাবনার বাস্তবায়ন করতে হবে পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে। যদি এবার স্কুল খুলে ,তাহলে প্রথমেই পড়ুয়াদের দক্ষতার মূল্যায়ন করে তাদেরকে বর্তমান শ্রেণির উপযুক্ত করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে।দায়িত্ব অবশ্যই শিক্ষকদের। কাজটি মুখে বলা সহজ হলেও করে দেখানোটা কঠিন।তবে অসম্ভব বলে নির্লিপ্ত হব সেটি বিধেয় নয়। সময় এবং শ্রম যতটা জরুরি ততটাই জরুরি আন্তরিক ইচ্ছা। দায়িত্ব শিক্ষক সমাজের।তবে কমিউনিটি হেল্প বা সমাজের সাহায্য দরকার হতে পারে। সমাজকে কাজে লাগানোর উপায় শিক্ষকদের জানতে হবে।এক একটি পরিবার এক একটা সমাজ।পরিবার পড়ুয়াদের সুযোগ করে দিক শিক্ষার জগতে নিবিষ্ট হতে। পেন,পেন্সিল, খাতা ,সুষম খাবার, পরিচ্ছন্ন পোশাক, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং অমূল্য ভালোবাসা দিয়ে পরিবার তার পড়ুয়াদের স্কুলে পাঠিয়ে দিক।পরিবার গুলোর মাথায় সরকার তো আছেই।
দীর্ঘদিন ঘরবন্দি আছে পড়ুয়ারা।শিক্ষাঙ্গন শেখানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের প্রক্ষোভিক,মানসিক ও শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রও বটে।মনের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হয়েছে এই করোনা কালে। সহপাঠীদের সাথে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া, টিফিন ভাগ করে খাওয়া,দলাদলি করে খেলাধূলা করা, শিক্ষক শিক্ষিকাদের বকুনি খাওয়া প্রভৃতি কিছুর মধ্যে দিয়ে পড়ুয়াদের মনের স্বাস্থ্য তৈরি হয়।তারা সাফল্য ,ব্যর্থতা, জয়,পরাজয় প্রভৃতিতে মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা অর্জন করে।এই সকল বন্ধ থেকেছে স্কুল বন্ধ থাকার সাথে সাথেই।খুঁজতে হবে পড়ুয়াদের মন ব্যাথার কারণ।শিক্ষা দপ্তরের সাথে স্বাস্থ্য বিভাগের নিবিড় সংযোগ ঘটিয়ে মানসিক বিকাশের পথটিকে পুনরায় সচল করতে হবে। এমনকি শারিরীক স্বাস্থ্যের দিকটিও এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। মাঝ দুপুরে একটা আস্ত মিল প্রান্তিক গোষ্ঠীর পরিবারের ছেলে মেয়েদের কাছে মহাভোজের সমান ছিল।শত শত পরিবারে যেখানে এই করোনা কালে আর্থিক বিপর্যয় ঘটেছে ,সেখানে পড়ুয়াদের পুষ্টির ঘাটতি থাকবেই ধরে নেওয়াই যায়। স্কুল খোলার পাশাপাশি মিড ডে মিলের সুদিন ফিরিয়ে আনা উচিৎ।
করোনার বীভৎসতা পড়ুয়াদের মনে সুগভীর ক্ষত তৈরি করেছে। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সংক্রমণ ও মৃত্যুর ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে আশঙ্কা ও ভয়ের বাসা তৈরি হয়েছে পড়ুয়াদের মনের গভীর গহনে।সবুজ কিশলয় মন গুলিতে ভয় মুছে সচেতনতার জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে শিক্ষক শিক্ষিকাদের সবিশেষ চেষ্টা করতে হবে।
শিক্ষার বিপর্যয় ভবিষ্যতের জন্যে সর্বনাশের ইঙ্গিতবাহী। কিন্তু সর্বাত্মক চেষ্টা করলে আমরা অবশ্যই পারব বিপর্যয় কাটিয়ে আলোর মাঠে ফিরতে।

নিউজ ডেস্ক: ‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: ss.ghatal@gmail.com •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।