‘নববর্ষ’ —উমাশংকর নিয়োগী

 ‘নববর্ষ’  —উমাশংকর নিয়োগী
১ লা বৈশাখে কি বৈদিক যুগেও বছর আরম্ভ হত ? এর উত্তরে না -ই হবে। পৌরাণিক যুগে রচিত মহাভারতে অন্তর্ভুক্ত পবিত্র গীতার এক জায়গায় আছে, ‘ মাসানাং মার্গশীর্ষোঽহম ‘। মার্গশীর্ষ মাস বলতে অগ্রহায়ণ মাস বোঝায়। পূর্বে বছর শুরু হত অগ্রহায়ণ মাসে। আবার অনেকের মতে বর্ষা কালে বছর শুরু হত। বর্ষা থেকেই বর্ষ শব্দের ব্যবহার হচ্ছে। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত যজুর্বেদ বারো মাসের নাম না থাকলেও বারো মাসের কথা উল্লেখ আছে।’ শতপথ ব্রাহ্মণে ‘ প্রথম বৈদিক যুগের বারো মাসের নাম পাওয়া যায়। এখানে আবার মাস গণনা শুরু হয়েছে ফাল্গুন চৈত্র থেকে। বৈদিক মাসগুলির নাম মধু- মাধব ফাল্গুন চৈত্র, শুক্র- শুচি বৈশাখ জৈষ্ঠ্য, নভস্- নভস্য আষাঢ় শ্রাবণ, ঈষ-ঊর্জ ভাদ্র আশ্বিন, তপস-তপস্য কার্তিক- অগ্রহায়ণ, সহস্ সহস্য পৌষ মাঘ।
বিশাখা নক্ষত্রের সব চেয়ে কাছে থাকে এ মাসের পূর্ণচ্ন্দ্র। তাই এই মাসের নাম বৈশাখ মাস। বৈশাখ মাস বঙ্গাব্দের প্রথম মাস। ১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের শুরু। ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জী শুরু হয় ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ, ১৮৭৯ শকাব্দের ১ চৈত্রকে নববর্ষের দিন ধরে। ‘ নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান ‘ এর মত ভারতে নানারকমের সাল গণনা আছে। ৫৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হওয়া বৌদ্ধাব্দ, ৫২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরম্ভ হওয়া মহাবীরাব্দ , খ্রিস্টাব্দ ,শকাব্দ, হিজরি সন , ওড়িশার ‘আমলী সন’ উত্তর ভারতের ‘ ফসলী সন’ অসমের ‘ভাস্করাব্দ’ ‘ বিক্রমসংবত’প্রভৃতি। পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে সমগ্র ভারত জুড়ে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনটি সাড়ম্বরে নববর্ষের শুভারম্ভ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে ইংরেজ আমল ধেকে। এ ছাড়াও ভারতের অন্যান্য প্রদেশে নববর্ষ পালিত হয় ভিন্ন ভিন্ন মাসে, দিনে। উত্তর ভারতের অনেকগুলি প্রদেশে নববর্ষের সূচনা বিক্রমসংবতের প্রথম দিন,চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে। কেরালায় ‘কেল্লাম’ বর্ষের আরম্ভ হয় ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা নবমীর দিন। গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে দেওয়ালির দিন নববর্ষ পালন করা হয় । পাঞ্জাব,হরিয়ানা, কাশ্মীরে বৈশাখী উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। বাংলা অসম এবং ওড়িশায় বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে নববর্ষের সূচনা হয়।
প্রতিটি অব্দের সূচনা হয়েছে কোন না কোন ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। কোন মহামানবের জন্ম, সম্রাট বা রাজার রাজ্যাভিষেক বা রাজ্যজয় মূলত এইসব ঘটনাকে সামনে রেখে নতুন অব্দের শুরু হয়। এই যে, আমরা ১৪২৯ বছর ধরে ১ লা বৈশাখ নববর্ষ পালন করছি এর পেছনে কোন ঐতিহাসিক ঘটনা আছে তা আমাদের জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অনুমান, ধোঁয়াশাকে অবলম্বন করেই বঙ্গাব্দের সূচনা সময় নির্ণয় করেছেন ঐতিহাসিকগণ। আর এর উপরে নানা মত তো আছেই। ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন বঙ্গাব্দের প্রচলন করেছেন গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে শশাঙ্ক নিজেকে গৌড়ের স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর রাজ্যকে পশ্চিমে কান্যকুব্জ থেকে দক্ষিণে গঞ্জাম পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। তাঁর সময় কালে কোন এক রাজ্য জয়কে স্মরণীয় করতেই বঙ্গাব্দের প্রচলন। ভিন্ন মতাবলম্বীরা মনে করেন বঙ্গাব্দের প্রচলন করেছেন বাদশাহ আকবর। আকবর দিল্লির মসনদে বসেন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ।সেই সময় হিজরি সন ৯৬৩। চান্দ্রমাস অনুসারে হিজরি হয়। ফলে এক ঋতুতে নববর্ষের আরম্ভ হয় না। বাংলার প্রজারা খাজনা দিতে অসুবিধার সম্মুখীন হত তাই বাদশা আকবর তাঁর মসনদে বসার হিজরি সনকে সৌরমাসের বঙ্গাব্দের বৎসর হিসেবে প্রচলন করে দিলেন।
কিন্তু ‘আইন- ই-আকবরী’তে বাংলা সনের উল্লেখ নেই। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর দ্বারা ইরানের সৌর পঞ্জিকা অনুকরণে প্রচলিত ‘ তারিখ-ই-ইলাহি ‘ সাল গণনা শূন্য থেকেই শুরু। শশাঙ্কের রাজত্ব কাল থেকে আকবরের সিংহাসনে বসার সময় পর্যন্ত ৯৬৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। এমনটা তো হতে পারে যে, শশাঙ্কের প্রচলিত অব্দকে ধরেই আকবর বাংলা সনের প্রচলন করেছিলেন। যাই হোক, ১ বৈশাখে নববর্ষের শুভারম্ভ অন্তত পাঁচশো বছর পূর্ব থেকে পালিত হয়ে আসছে। চৈতন্যদেবের জন্মের পঁচিশ বছর পরে স্মার্ত রঘুনন্দন জন্ম গ্রহণ করেন। রঘুনন্দনের নবদ্বীপ পঞ্জিকায় নববর্ষ শুরু বৈশাখ মাস থেকেই।
শাস্ত্র বলেছে ‘ প্রাপ্তে তু নূতন বর্ষে প্রতি গৃহং কুর্যাৎ ধ্বজা রোপণম্। মেষার্ক যাবৎ প্রত্যহং প্রাতঃস্নানং কর্তব্যং। ‘১৩০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে প্রথমবার ধর্মীয় বাতাবরণ থেকে ১ বৈশাখকে সরিয়ে সাড়ম্বরে নববর্ষের দিনটি সামাজিক উৎসব হিসেবে পালন করেন। বর্তমানে ১ লা বৈশাখ সামাজিক উৎসবের দিন। সংগীত ,আবৃত্তি, নৃত্য, আলোচনার মধ্য দিয়ে বহু জায়গাতে পালিত হচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াও গুরুত্ব দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করে। ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের পালিত নববর্ষে কেবল সরস কলাবিদ্যার রসাস্বাদন হয় না , এর সঙ্গে থাকছে রসনা তৃপ্তির নিমিত্ত বেগুন পোড়া, পান্তা ভাত, আলুপোস্ত , আম পোড়া শরবত ইত্যাদি।প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পান্তা ভাত, বেগুন পোড়া, আলু সেদ্ধ, মাছ ভাজা খেয়ে নববর্ষ উদযাপন করা হয়।
বৈশাখ আসে রুদ্র রূপে, দাবদাহ আর কাল বৈশাখী ঝড় সঙ্গে নিয়ে। বৈশাখের ‘তপক্লিষ্ট তপ্ত তনু ‘ ‘ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন জটাজাল ‘।মুখে তার’ বিষাণ ভয়াল’। পুরাতন বর্ষের হতাশা, ব্যর্থতার গ্লানি, বিষাদ বেদনা, জরাজীর্ণতাকে মন থেকে মুছে ফেলে নতুন করে লড়াই করে বাঁচার স্বপ্ন বোনার দিন ১ লা বৈশাখ।আমাদের প্রার্থনা, হে ১ লা বৈশাখ! ” হে বৈরাগী, শান্তি করো পাঠ।/ উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণ ও বামে- / যাক নদী পার হয়ে, যাক চলি গ্রাম হতে গ্রামে, /পূর্ণ করি মাঠ।/ হে বৈরাগী , করো শান্তিপাঠ।”

নিউজ ডেস্ক: ‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: ss.ghatal@gmail.com •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।