‘দাসপুর থানার মৃন্ময়ী মূর্তিতে পারিবারিক দুর্গোৎসব’ —উমাশংকর নিয়োগী

দাসপুর থানার মৃন্ময়ী মূর্তিতে পারিবারিক দুর্গোৎসব
—উমাশংকর নিয়োগী
•দাসপুর থানার পারিবারিক দুর্গোৎসব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যাওয়ার আগে দুর্গা নামের উৎপত্তি কোথা থেকে হল আর দেবী দুর্গার পুজো কত বছর ধরে চলে আসছে সেই বিষয়েও সামান্য জেনে নিতে পারা যায়। পণ্ডিতদের মতে দেবী দুর্গম বা দুর্গ নামক দৈত্য বধ করেছেন বলে তাঁর নাম দুর্গা। ‘তৈত্তিরীয় আরণ্যক’ এ প্রথম দুর্গা শব্দটি পাওয়া গিয়েছে। ভারতে শক্তি সাধনার এবং পুজোর ইতিহাস ছ’হাজার বছরের বেশি পুরানো। পাথরের বা ধাতু মূর্তিতে মহিষাসুরমর্দিনীর পুজো সুপ্রাচীন। তাও নয় নয় করে দু’হাজার বছর পূর্বের ঐতিহাসিক

নিদর্শন থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বহু প্রাচীন পুঁথির পাতায় ,জীর্ণ মন্দির গাত্রে মহিষাসুরমর্দিনীর বর্ণনা ও মূর্তি পাওয়া গিয়েছে ।স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর ‘ মহিষাসুরমর্দ্দিনী – দুর্গা ‘ গ্রন্থে লিখেছেন, ” দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিনী – দুর্গার পূজা কতদিন ধরে পৃথিবীর সমাজে চলে আসছে তার যথাযথ নির্ণয় আজ – পর্যন্ত হয়নি। তবে যে ভাবে মহাভারত, হরিবংশ প্রভৃতিতে দুর্গার বর্ণনা, দুর্গার (আর্যরা) স্তব, প্রভৃতি চলে আসছে তা থেকে মনে হয় বাংলাদেশে যে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আড়ম্বরের ভাব নিয়ে দেবী দুর্গার পূজা হয়,তার বয়স আনুমানিক দু’হাজার বছরেরও বেশী হবে । ”
মার্কণ্ডেয় পুরাণের মতে রাজা সুরথ

ও সমাধি বৈশ্য প্রথম মাটির দুর্গা প্রতিমা গড়ে মেধামুনির আশ্রমে দেবীর আরাধনা করেছিলেন। তিনিই পূজান্তে দেবীর বিসর্জনের প্রথা শুরু করেন।মেধামুনির আশ্রম ছিল চট্টগ্রামে। পণ্ডিতদের অনুমান রাজা সুরথের রাজধানী বলিপুরই বর্তমানের বোলপুর এখান থেকে তিনি বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই মৃন্ময়ী মূর্তির সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী,সরস্বতী ছিল না।
বর্তমানে মাটির তৈরি কার্তিক,গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী সহ দেবীর শরৎকালে যে আরাধনা হয় তা তাহিরপুরের ভূস্বামী কংসনারায়ণ তাঁর কুল পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রী রচিত পদ্ধতি অনুসরণ করে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রচলন করেন।
দাসপুরের অর্থনৈতিক শক্তবুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছিল মূলত কৃষি আর রেশম ও রেশমজাত পণ্য উৎপাদন করে, রেশমজাত পণ্যের ব্যবসা করে । অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে দাসপুর থানাতে অনেক বনেদি বাড়িতে দুর্গোৎসব হত এর কিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছে আর কিছূ চলছে। বাসুদেবপুরের কায়স্থ রায়েদের দুর্গোৎসব, এই পুজো কিছু বৎসর তাঁদের কুল পুরোহিত পঞ্চানন রায়েদের বাড়িতে হয়েছিল। এখন আর হয় না। চাঁদপুরের বনবিহারী ঘোষ পরিবারের পারিবারিক দুর্গোৎসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখনো দাসপুর থানায় আঠারোটি পারিবারিক দুর্গোৎসব হচ্ছে।
🥀সামাটের ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গোৎসব ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে। এই বংশের বিখ্যাত পণ্ডিত রাখাল ভট্টাচার্য। নাড়াজোলের রাজপরিবারের কুল পুরোহিত সামাটের ভট্টাচার্যরা। রাজাদের জয়দুর্গা আছেন তাই আলাদা মূর্তি করে দুর্গা পুজো হয় না, জয়দুর্গার মন্দিরে দুর্গোৎসব হয়। অমরেন্দ্রলাল খাঁনের পুরোহিত ছিলেন হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য। মূলত রাজ আনুকূল্যই ভট্টাচার্যদের দুর্গোৎসব আরম্ভ হয়। এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত রাজবাড়ি থেকে আর্থিক সাহায্য আসত। একই মেড়ে পুজো করা এঁদের সাবেক রীতি। কার্তিক, গণেশ ইত্যাদি সহ দেবীর দুই পাশে আছেন জয়া, বিজয়া। দেবী দুর্গার গাত্রবর্ণ কাঞ্চনাভ। সপ্তমীর দিন সাত রকমের, অষ্টমীর দিন ষোল রকমের এবং নবমীর দিন নয় রকমের ভোগ দেওয়া হয়। এক কালে এদিন গোটা গ্রামের মানুষ অন্ন প্রসাদ পেতেন। দশমীর দিন ভোগ রান্না হয় না দেবদেবীকে পান্তা ভোগ দেখানো হয়। ভোগে প্রতিদিন চিংড়ি মাছ আর চিনির জিলিপি দেওয়া বাধ্যতামূলক। তাপস ভট্টাচার্য জানালেন পূর্বে বলি হত এখন আর বলি হয় না। বর্তমানে ভট্টাচার্যদের নটি পরিবার পুজোর সমূহ খরচ বহন করেন।
🥀সামাটের পট্টনায়কের পারিবারিক দুর্গোৎসবও ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে হয়ে আসছে। সামাটের এই দুটি দুর্গোৎসব গুরু শিষ্যের পুজো নামে সুপরিচিত। প্রায় পাশাপাশি দুটি পরিবারের দুর্গাপুজো দাসপুরের আর কোথাও নেই। পট্টনায়কেরা জাতিতে মাহিষ্য। ব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন এঁদের পূর্ব পুরুষ। ভট্টাচার্যরা এঁদের গুরু বংশ। পট্টনায়কেরা প্রতিদিন পুজোতে বসার পূর্বে চিরাচরিত প্রথা অনুসারে এখনো কিছু গুরু প্রণামী দিয়ে এসে পুজো শুরু করেন। দেবী পক্ষের প্রতিপদে ঘট কওঠে। প্রতিদিন পুজো ও চণ্ডী পাঠের ব্যবস্থা আছে।একচালায় সমস্ত দেবদেবী। জয়া বিজয়া নেই। ছাগ বলি আছে। বিশেষ বৈশিষ্ট্য সন্ধি পুজোতে একাধিক বলি হয়। শিবা বলিতে রক্ত উৎসর্গিত হয়। পট্টনায়কদের দুর্গোৎসবে সপ্তমীর দিন যে হোমাগ্নি প্রজ্বলিত হয় দশমীর দিন পর্যন্ত তা অনির্বাণ থাকে। এখনো চারদিন পুজোর জন্য এক কুইন্টাল চাল বরাদ্দ আছে ।সৌরভ পট্টনায়ক জানালেন তাঁদের দুর্গার নামে কুড়ি বিঘা জমি এখনো আছে।
🥀বলিহারপুরের ভট্টাচার্যদের আঠারো হাত দুর্গার পুজো চৈতন্যদেবের সমকাল থেকে চলে আসছে বলে দাবি করলেন এই বংশের দৌহিত্র রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বলিহারপুরের ভট্টাচার্য বংশ বিখ্যাত পণ্ডিত বংশ। পণ্ডিত রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের দুই পুত্র যোগেশচন্দ্র ও ভবেশচন্দ্র কৃতবিদ্য ছিলেন। এঁদের বাড়ির অতসী ফুলের রঙের দুর্গার হাঠারো হাতে আঠারো অস্ত্র। সিংহের থাবা মহিষাসুরের বুকে। এই বংশের বিখ্যাত তান্ত্রিক বাণীভূষণ ভট্টাচার্যের লেখা প্রাচীন পুঁথি অনুসরণ করে পুজো হয়। জীতাষ্টমীর সন্ধে বেলাতে দেবীর বোধন ও পরের দিন নবমী থেকে কল্প আরম্ভ হয়ে যায়। পূর্বে পুজোতে ছাগ বলি হত বর্তমানে কুষ্মাণ্ড বলি হয়। ষষ্ঠীর দিন থেকে দেবীকে অন্ন ভোগ নিবেদন করা হয়। কচু ,পুঁই শাক ও চিংড়ি মাছের তরকারি ভোগের জন্য অবশ্যই করতে হয় । নবমীর রান্না দশমীর দিন পান্তা ভোগ হিসেবে দেবীকে নিবেদনের রীতি এখনো চলছেএই পরিবারে।
🥀বলিহারপুরের কায়স্থ রায়েদের দুর্গোৎসব ৩৫০-৪০০ বছরের পুরোনো বলে জানিয়েছেন প্রদীপ কুমার রায়। রায়েদের জমিদারি ছিল। রঞ্জিত রায় রায়বাহাদুর খেতাব পেয়ে ছিলেন । একচালাতে পুজো। লক্ষনীয় বৈশিষ্ট্য হল কার্তিক গণেশ উপরে, লক্ষ্মী সরস্বতী নীচে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বড়দার রাজা শোভা সিংহের আরাধ্যা দেবী বিশালাক্ষীর কার্তিক, গণেশ উপরে। দাসপুর থানার বাসুদেবপুরের কায়স্থ রায়েদের (অধুনা লুপ্ত), সয়লার সিংহ পরিবারে, দাসপুরের বঙ্গরাম চৌধুরী ও রাধাকান্তপুরের তালুকদার বসুদের পারিবারিক দুর্গা প্রতিমা নির্মাণে একই রীতি অনুসৃত হয়। এর থেকে বোঝা যায় শোভা সিংহের সঙ্গে এই পরিবারগুলোর কোন না কোন যোগ সূত্র অবশ্যই ছিল। রায়েদের কৃষ্ণ পক্ষের নবমীতে ঘট ডোবানো হয়। ঐ দিন থেকে দেবীর পুজো ও চণ্ডীপাঠ শুরু হয়। এঁদের বিশ্বাস বড়পুকুরের ঈশান কোণ থেকে চামুণ্ডা দেবী উঠেছেন। এঁদের ব্রজলালকিশোর জিউর মন্দিরে স্থানাভাবে শীতলা ও চামুণ্ডা আশ্রিত হয়েছেন। সন্ধি পুজোর সময় দেবী দুর্গার দালানে চামুণ্ডা দেবী বারামে আসেন। পূর্বে চাঁদপুরের বেথুয়াবাড়ির সন্ধি পুজোর কামানের শব্দ শুনে রায় বাড়িতে সন্ধির বলি হত। ছাগ বলির পর রুধিরসরা ও ছাগমুণ্ড বড়পুকুরের ঈশান কোণে জলে এখনো দিয়ে আসা হয়। এ পুজো কেবল আর রায়েদের নেই। রায় বংশের দৌহিত্র সোম, মিত্র ও বিশ্বাসদের পারিবারিক পুজোও।
🥀হাটগেছিয়ার হরতকীতলার আঠারো হাত দুর্গার পুজো দীপঙ্কর চক্রবর্তীদের পারিবারিক দুর্গোৎসব। এঁদের দাবী এই পুজো সাতশো(!) বছরের পুরোনো। দেবীর আঠারো হাতেই অস্ত্র। দেবীর ঘট উঠে জীতাষ্টমীর দিন বোধন হয় । ঐ দিন থেকে নিয়মিত পুজো ও পাঠ চলতে থাকে। দেবীর পঞ্চ মুণ্ডির আসন। এঁদের নিজস্ব পুঁথি অনুসরণ করে পুজো হয়। ছাগ বলি আছে। বলির মাংস রান্না করে ভোগের সঙ্গে উৎসর্গ করা হয়। অন্ন ভোগের সঙ্গে চিংড়ি মাছ, কচু ,পুঁই শাকের তরকারি দিতে হয় প্রতিদিন। এর সাথে লংকা পোড়া অবশ্যই দিতে হয়। সন্ধ্যারতির সময় চালকড়াই ভাজা দেওয়া হয়। সন্ধি পুজোতে বলি দেওয়া ছাগমুণ্ড গভীর রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে জলে ভাসানো হয়। এর চামড়াটি একটি নিখুঁত মাটির হাঁড়িতে করে জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। দশমীর দিন সেই চামড়ার ও শান্তি জল চারি দিকে ছেটানো হয়।
🥀দাসপুরের বঙ্গরাম চৌধুরীদের পারিবারিক দুর্গোৎসব দাসপুরের প্রাচীনতম পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম। এক মেড়ের দশ হাতের দুর্গা ঠাকুর। কার্তিক, গণেশ উপরে থাকেন। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গরাম চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত একটি একরত্ন মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। অনুমান করা যেতে পারে অন্তত সেই সময় থেকে এঁদের পারিবারিক দুর্গোৎসবও আরম্ভ হয়েছে। বাইরে থেকে যে কটি পরিবার ভাগ্য ফেরাতে দাসপুর এসেছিল বঙ্গরাম চৌধুরী পরিবার তার মধ্যে একটি। দেবীর গায়ের রঙ অতসী ফুলের মত। পূর্বে বলি হত । দুর্গোৎসব উপলক্ষে চৌধুরীদের আঙিনায় একসম বহু যাত্রার আসর বসেছে। চৌধুরীদের সবাই দাসপুরের বাইরে থাকেন। প্রণব চৌধুরী জানালেন পুজোর কদিন তাঁরা দাসপুরে আসেন।
🥀খেপুতে এক সময়ের জমিদার চক্রবর্তীদের পারিবারিক দুর্গোৎসব তিনশো পঞ্চাশ বছরের পুরোনো বলে তাঁরা জানালেন। মধুসূদন চক্রবর্তী বলেন তাঁদের দশভূজা দেবী আর পাঁচটি বাড়ির মূর্তি মতো হলেও , সরস্বতীর তিনটি চোখ। দাসপুর থানাতে আর কোন পারিবারিক পুজোর সরস্বতী এমন নয়। এঁদের প্রতিপদ থেকে কল্প আরম্ভ হয়। তন্ত্র ধারক ও পূজক সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত দিনের বেলায় অন্ন গ্রহণ করেন না। রাত্রিতে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময় থেকে চলে আসা এই পুজো মন্মথনাথ চক্রবর্তীর আমলে পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলি হল, অষ্টমীতে ছাগবলি দান ,নবমীতে পান্তা ভাত , মাছ পোড়া ,চিংড়ি মাছ ভোগ হিসেবে নিবেদন করা। ছাগবলি সন্ধি ও অন্যান্য পুজোতে তো ছিলই। চক্রবর্তীদের সোনাদিঘির মাছ রান্না করে প্রতিদিন ভোগের সঙ্গে দেওয়া হয়ে থাকে। দুর্গোৎসবের সময় চারপাঁচশো ভক্ত অন্ন প্রসাদ পায়। এঁদের কুলদেবতা মদনমোহনের মন্দিরটি দ্বিতল। মন্দিরে একটি সিংহবাহিনীর ধাতু মূর্তি আছে।
🥀রাধাকান্তপুরের দাসেদের পারিবারিক দুর্গা পুজো সম্পর্কে স্বপনকুমার দাস জানালেন, তাঁদের পারিবারিক দুর্গা পুজো ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন শ্যাম দাস । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রাধাকান্তপুরের বিখ্যাত গোপীনাথের মন্দির এই শ্যাম দাস কর্তৃক ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরই পাশে দুর্গামণ্ডপ। শ্যাম দাস পরবর্তী সময়ে শোভা সিংহের সমস্ত সরোবর খননের তদারকি করতেন। শ্যাম দাসের নিজ গড় তৈরি ও বড় পুকুর কাটাতে আরম্ভ করায় ক্রুদ্ধ শোভা সিংহ এঁর মুণ্ডচ্ছেদ করেন। সেই কাটা মুণ্ড ‘দুর্গা, দুর্গা ‘ বলেছিল। তালপাতায় লেখা কালীকাপুরাণোক্ত সুপ্রাচীন পুঁথি অনুসরণে এখনো এঁদের দেবীর পূজা হচ্ছে। দেবীর দুটি নবপত্রিকা ও জোড়া অধিবাস হয়। এই রীতি দাসপুর থানাতে কেবল এঁদের বাড়িতেই আছে। ষষ্ঠীর দিন সন্ধেতে একটি নবপত্রিকা মন্দিরে প্রবেশ করে। অন্যটি যথারীতি পুকুরে নবপত্রিকায় মহাস্নান শেষে মন্দিরে আনা হয়। স্নানে দশ মৃত্তিকার ব্যবহার নেই। দেবীর গায়ের রং গলানো সোনার মতো। সন্ধি পুজোর সময় চৌষট্টি যোগিনীর ধ্যান মন্ত্রে স্বাতন্ত্র্য আছে। সন্ধি পুজোতে চুয়ান্নটি প্রদীপ জ্বলে, নবমীতে একশো আট প্রদীপ প্রজ্বলিত হয়। পূর্বে ছাগ ও মেষ বলি প্রথা ছিল। সপ্তমীর ভোরে এদের বাড়িতে রক্ষিত একটি পুঁথি পড়া হয় তাতে একটি অংশে ” বাঙাল কাঁদেরে ” বলে একটি অধ্যায় আছে। এই অংশে তৎকালের বাংলার সমাজচিত্র সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে । অষ্টমঙ্গলা গান করেন পরিবারের মেয়েরা। এঁদের বাড়িতে একটি বাশুলী দেবীর প্রাচীন পুঁথি আছে।
🥀রাধাকান্তপুরের তালুকদার বসু বাড়ির দুর্গোৎসব আড়াইশো বছরেরও বেশি পুরোনো বলে জানালেন বসু পরিবারের দৌহিত্র বংশের মলয়(ডাকু) দাস। এঁদের কুলদেবী রাজরাজেশ্বরীর পঞ্চরত্ন মন্দিরের পাশেই দুর্গা মণ্ডপ। রাজরাজেশ্বরীর মন্দিরটি ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটির সংস্কার করেন রামবঙ্গ বসু। সেই সময়ে প্রতিষ্ঠা কালের লিপিটি নষ্ট হয়ে যায়। শ্বেতপাথরে খোদিত করে লিপিটি সংরক্ষিত করেন রামবঙ্গ বসু। দুর্গোৎসব ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের সম সমকালে আরম্ভ হয়েছিল বলে এঁদের বিশ্বাস। ধনঞ্জয় বসুরা মনে করেন জমিদারি সূত্রে আয়েই তাঁদের পরিবারের সমৃদ্ধি হয়েছে। শোভা সিংহের অনুগামী বসুদের শোভা সিংহের আরাধ্যা দেবীর মতোই এক চালের প্রতিমায় কার্তিক গণেশ উপরে লক্ষ্মী সরস্বতী নীচে থাকেন। ছাগ বলি আছে। নবমীর দিন রাজরাজেশ্বরী বারামে আসেন। প্রতিদিন ক্ষীর দিতে হয় দেবীকে। দেবীর গায়ের রঙ গলানো সোনার মতো। মাঝে কিছুদিন বসু বাড়িতে প্রতিমা করে দুর্গা পুজো বন্ধ ছিল। বর্তমানে নিয়মিত পুজো হচ্ছে।
🥀১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কাপড়ের আমদানি রপ্তানির ব্যবসা করে প্রভূত উন্নতি করেন নিমতলার বৈকুন্ঠনাথ গুঁই ও তাঁর তিন ভাই। বৈকুন্ঠনাথ গুঁই ও তাঁর ভায়েরা ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিমতলার বাড়িতে তাঁদের পারিবারিক দুর্গোৎসব শুরু করেন। কুলদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন জিউ , রামচন্দ্র জিউ সহ দুর্গা পূজাদির খরচ বহন করার জন্য পাঁচশ বিঘা জমি দেবতার নামে অর্পণনামা দলিলের মাধ্যমে দেবতাকে অর্পণ করেন। জাঁকজমকে, গুঁইদের বিপুল ব্যয়ে দুর্গা পুজো করার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কামান দাগা, ঝাড়বাতির রোশনাই, আতস বাজি সব বজায় ছিল ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ।পরে দেবোত্তর সম্পত্তি ভেস্ট হয়ে গেলে ব্যয় কমতে থাকে। প্রতিপদের দিন কল্প আরম্ভ হয় । চণ্ডীপাঠ ও পুজো চলে নিয়মিত।সপ্তমীর দিন মহার্ঘ বস্ত্রে সুসজ্জিত করে পাল্কীতে নবপত্রিকা নিয়ে স্নান ও ঘট ডোবাতে যাওয়া হয়। নদী থেকে অম্বিকা ঘট, গণেশ ঘট ,নবপত্রিকা সব নিজরা বহন করে আনা এঁদের পারিবারিক রীতি। দুর্গার সমস্ত অস্ত্র ও অলংকার রুপোর। পুজোর বাসন, ভোগ নিবেদনের থালাগুলিও সাবেকি রুপোর তৈরি। দেবীকে মুগের পাল, পানিফলের পাল দেওয়া হয়ে আসছে প্রথমাবধি। পুজোর কদিন গুঁই পরিবারের সবাই এক সাথে খাওয়া দাওয়া করেন। এক মেড়ের ঠাকুর নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়।
🥀রাণার চক্রবর্তীদের পারিবারিক দুর্গোৎসব প্রায় দুশো বছরের পুরাতন বলে জানিয়েছেন স্বপন চক্রবর্তী । চক্রবর্তী পরিবারের সমৃদ্ধির উৎস ছিল কয়েকশো বিঘা জমি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা। এঁদের বিপুল সম্পত্তি,খ্যাতি প্রতিপত্তি থাকলেও পরিবারে কয়েক পুরুষ ধরে কোন কন্যা সন্তান ছিল না। চক্রবর্তীদের পূর্ব পুরুষ ত্রিলোচন চক্রবর্তীর আমলে এক সন্ন্যাসী এসে দুর্গোৎসব করলে কন্যা সন্তান হবে বলে জানিয়ে যান। ত্রিলোচন সন্ন্যাসীর কথা মত দেবীর পুজো করেন এবং কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করেন। তাঁদের বংশে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে এঁদের পরিবারে দুর্গা পুজো চলে আসছে। পূর্বে বলি ছিল । গ্রামের রামাৎ বৈষ্ণবগণের অনুরোধে বহু বছর আগে বলি প্রথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সপ্তমী,অষ্টমী, নবমীর দিন নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হলেও দশমীর দিন চিংড়ি মাছ সহ পান্তভাত নিবেদন এঁদের পারিবারিক রীতি। দশমীতে যথারীতি মন্ত্র বলে নবপত্রিকার গাছ লতা এক এক করে বিসর্জন করা হয়। দশমীর বিসর্জনের শেষে এই পরিবারের সকল সদস্য একটি সংরক্ষিত খাতায় দুর্গা নাম বা বীজ মন্ত্র লেখেন।
🥀সয়লার সী পরিবারের পারিবারিক দুর্গোৎসব। ললিতমোহন সী ও স্বপন সী জানালেন তাঁদের দুর্গা পুজো প্রায় দুই শতাধিক বছরের প্রাচীন। এই দুর্গোৎসব শুরু করেছেন মাধবচন্দ্র সী। মূলত কৃষিই এঁর আয়ের প্রধান উৎস ছিল। এঁদের প্রতিপদে ঘট ওঠে। পুজো ও পাঠ দুই চলে। এক মেড়ের প্রতিমার চালচিত্রে বহু দেবদেবীর মূর্তি আঁকা হয়। লক্ষ্মী,সরস্বতী মেড়ের উপরে থাকেন। আজুড়িয়ার সুধীর সাঁইরা পুরুষানুক্রমে দেবীর প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। প্রথম থেকেই ছাগ বলি নেই। সন্ধির সময় চিনি বলি দেওয়া হয়। প্রতিদিন দেবীর ভোগে ক্ষীর , লুচি, সন্দেশ দেওয়া হয় এর সাথে গুড়পিঠে অবশ্যই দিতে হয়। পুজো করতে আসেন সী পরিবারের গুরু বংশ মনশুকার গোস্বামীরা। প্রথম থেকেই কুমারী পুজোর চল আছে। দশমীর দিন পঙ্ তি ভোজের সাড়ম্বর আয়োজন পুজো শুরুর সময় থেকেই চলে আসছে।
🥀ভাগ্যান্বেষণে বাইরে থেকে দাসপুরে এসে যে কটি পরিবার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্যে সয়লার সিংহ পরিবার উল্লেখযোগ্য। আনুয়া থেকে সিংহরা সয়লায় উঠে আসেন। এঁদের সমৃদ্ধির মূলে ছিল ব্যবসা আর ভূসম্পত্তি । সয়লার পার্শ্ববর্তী একটি মৌজার নামই সিংহচক। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে গম্ভীরচরণ সিংহ একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। অনুমান করা যেতে পারে তাঁর সময় কাল থেকে সিংহ পরিবারের দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে। মন্দির প্রতিষ্ঠা কাল থেকে এই পরিবারের ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসব শুরু হলে ,তা কম করে ২৭৯ বছরের বেশি পুরোনো। শোভা সিংহের অনুগামী এই পরিবারেরও দুর্গার মেড়ে উপরে কার্তিক, গণেশ নীচে লক্ষ্মী, সরস্বতী। এই পরিবারের সদস্য সুকান্ত সিংহ জানালেন, তাঁদের পূর্ব পুরুষ গম্ভীরচরণ জন্মাষ্টমীর রাত্রে স্বপ্নাদেশ পান, কংসাবতীর শাখা নদীতে আজুড়িয়ায় যে দুর্গা প্রতিমার কাঠামো আটকে আছে তাকে নিয়ে এসে যেন প্রতিমা তৈরি করে সিংহ বাড়িতে দুর্গোৎসব করা হয়। প্রয়োজনে বালির নৈবেদ্য দিয়েও পুজোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। আজও সিংহ বাড়ির দুর্গা পুজোতে প্রতিদিন বালির পরিবর্তে চিনির নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়।পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে নন্দোৎসবের দিন আজুড়িয়ার নদী থেকে মাটি তুলে আনা হয়। বলি প্রথা ছিল । ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশেষ কারণে বলি প্রথা উঠে গিয়েছে। প্রতিপদে দেবীর ঘট উঠে। পুজো পাঠ শুরু হয়। বিসর্জনের পর নীল অপরাজিতা লতা সকলে হাতে বাঁধেন।
দাসপুরের অধিকাংশ পারিবারিক দুর্গোৎসবের উৎস ছিল জমির খাজনা আর ব্যবসা । ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ভূমিনীতি আইনের ফলে এঁদের সিংহভাগ জমি হাতছাড়া হয়ে যায়। আয়ের উৎস প্রায় শূন্যতে নেমে যায় ১৯৫৫ – ২০২১ কম দিন নয়। পুজোর খরচ বর্ধমান। কর্মীর অভাব, অবিশ্বাস আর সরিকি বিবাদে বিধ্বস্ত পরিবারগুলো তাঁদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পুজো বহু কষ্ট করে দুএক জনের কাঁধে ভার চাপিয়ে কোনক্রমে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। জনতার কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইতে এঁদের স্মৃতিকথা, আভিজাত্য হিমালয়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাই এই ঐতিহ্যশালী পুজোগুলি কতদিন বেঁচে থাকবে তার খবর ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে আছে।
🙏কৃতজ্ঞ এঁদের কাছে: সুকান্ত সিংহ, সুব্রত বুড়াই, সৌমেন মিশ্র, দেবাশিস ভট্টাচার্য।

নিউজ ডেস্ক: ‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: ss.ghatal@gmail.com •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।