দাসপুরের মন্দিরস্থাপত্য টেরেকোটা ফলকে ধর্মীয় আচার ও সমাজ চিত্র

‘দাসপুরের মন্দিরস্থাপত্য টেরেকোটা ফলকে ধর্মীয় আচার ও সমাজ চিত্র’ —উমাশংকর নিয়োগী 
♦পুরাতাত্ত্বিক বেগলার ও ফার্গুসন  বাংলার পোড়ামাটির অলংকরণ  যুক্ত মন্দির  সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত ঘটালেও  লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ  গুরুসদয় দত্তই প্রথম  ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার  টেরেকোটা সজ্জিত মন্দির সংস্কার ও সংরক্ষণের বিষয়ে   বিদ্বৎ সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমাদের বঙ্গদেশে বৌদ্ধ ও  ইসলামিক সংস্কৃতির হাত ধরে বহিরঙ্গ  মন্দির অলংকরণের  রীতির প্রবেশ ঘটে। এ সম্পর্কে ডেভিড ম্যাককাচ্চন  তাঁর ‘পোড়ামাটি মন্দির’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “ মুসলমানেরাই  পোড়ামাটির অলংকরণের রীতি এবং নকশা (বা স্থাপন কৌশল ) সম্পর্কে

পরিচয় ঘটায় এবং তা পরে মন্দির ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয় । পাণ্ডুয়া ,গৌড় কিংবা অন্যত্র (১৪ শ থেকে ১৫ শ শতাব্দীতে ) মসজিদ এবং সমাধি নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁরা পোড়ামাটির শিল্পকে নিয়ে গেলেন বহিরঙ্গ স্থাপত্যের কাছাকাছি।”
দাসপুরের টেরেকোটা শোভিত মন্দিরগুলি নিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছেন, ডেভিড ম্যাককাচ্চন, পঞ্চানন          রায় কাব্যতীর্থ, অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপদ  সাঁতরা , ত্রিপুরা বসু , প্রণব রায়, বিনয় ঘোষ, চিন্ময় দাশগুপ্ত , সুদীপ দাস প্রমুখ প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদেরা।
১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা কালের টেরেকোটার ফলক সহ ঘাটালের সিংহবাহিনীর মন্দিরে প্রাচীন নকশা আছে। তবে   দাসপুরের মানুষ ঠিক কখন  থেকে  সংস্কৃতির চর্চা আরম্ভ করেছিল তার সাল  তারিখ নির্ণয় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এই এলাকার জনগোষ্ঠীর  প্রাচীন  প্রথা ও কীর্তির সমষ্টিগত চিহ্ন তাদের  নির্মিত মন্দির গুলিতে অনুসন্ধান করলে  খুঁজে  পাওয়া যায়। দাসপুরের  মানুষের শিল্পকলা, মন্দির স্থাপত্য,  ধর্ম চর্চা , সঙ্গীত চর্চা, বাদ্যযন্ত্রের  ব্যবহার  , সামাজিক আচার ব্যবহার,  তাদের

ভোগ বিলাস, রসবোধ, সমস্যা ইত্যাদির সাক্ষী  হতে  কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে তাদের উত্তরসূরিদের অক্ষমতায়, অবহেলায় অনাদরে  দুশো থেকে  আড়াইশো  বছরেরও বেশি সময় ধরে  যে  সমস্ত মন্দির এখনও দাঁড়িয়ে  আছে  তাদের  সংখ্যা কম নয়। কংসাবতী,শিলাবতী, পারাং, পলশপাই খাল,  রূপনারায়ণের পলিতে  গঠিত দাসপুরের উর্বর মাটিতে জন্মানো তুঁতে পাতায়  উন্নত মানের রেশম কীট  চাষ  হত ।  এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তবুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছিল মূলত এই

রেশম কীট থেকে পাওয়া রেশম ও রেশমজাত পণ্য উৎপাদন ,বিপণনের উপর নির্ভর করেই।  এই শিল্পের  সহযোগী শিল্প ছিল দুগ্ধজাত  পণ্য।  ঘি, খোওয়া ক্ষীর,ছানা, পনির ইত্যাদি ভারতের বিভিন্ন  প্রান্তে  যেত।  এলাকার  কাঁসা পিতলের বাসনপত্রের  বড়  বাজার ছিল  মধ্য  প্রাচ্যের  দেশগুলিতে। দাসপুরের  দেবদেবী গৃহ  মূলত এরাই  নির্মাণ  করেছে। দাসপুরে নিরাভরণ  মন্দির খুবই  কম আছে। মন্দির প্রতিষ্ঠাতাগণ মন্দিরগুলি পোড়া  মাটির  ভাস্কর্য ফলক তথা টেরেকোটার ফলকে, বিভিন্ন  নকশায়, কাঠের দরজায়  খোদাই করা  অলংকরণে  শোভিত করেছেন ।
মন্দির স্থপতিরা সবাই  দাসপুর থানার  অধিবাসী ছিলেন   । এক সময়ে দাসপুর থানার  দাসপুরে, কোলমিজোড়ে  দক্ষতা সম্পন্ন সূত্রধরেরা (ছুতোর) বসবাস  করতেন। তাঁদের  মন্দির স্থাপত্যের, টেরেকোটা ফলক তৈরির ও কাঠ খোদাই করে নক্সা এবং মূর্তি গঠনের  সুখ্যাতি  সমগ্র জেলায়  ছড়িয়ে  পড়েছিল। খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের দ্বিতীয় অর্ধ থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের  মধ্যে দাসপুরের  বেশির ভাগ মন্দির গুলি  নির্মিত  হয়েছে। পোড়া মাটির ফলকে সুসজ্জিত, অলংকৃত এই  দেবালয়গুলি  বাংলা সংস্কৃতির অতুলনীয় মূল্যবান সম্পদ। আমাদের পূর্ব পুরুষগণের সৃষ্টি করা ,গর্ব করার মত অনুপম কীর্তির চিহ্নবাহী এই মন্দিরগুলি। দেবগৃহগুলি টেরেকোটায় তৎকালে মানুষের ধর্মবিশ্বাস,  সমাজজীবন ,  অবসর বিনোদন, অর্থনৈতিক  ও রাজনৈতিক  ইতিহাস প্রবেশদ্বারে, দেওয়ালে  বিধৃত করে আমাদের দেখানোর জন্য শবরীর প্রতীক্ষা করছে । এইসব অক্ষয় কীর্তি উত্তরাধিকারীর আর্থিক অসামর্থ্যে, অবহেলায়, অনাদরে,   সরকারি ঔদাসিন্যে, রাজনৈতিক বস্তুবাদী অবজ্ঞায় আজ হয় বিলুপ্ত  নয় বিলুপ্তির  পথে।
বাঙালি  হিন্দুরা  অধিকাংশ  পঞ্চোপাসক। মিলে মিশে  থাকার, অপরের বিশ্বাসকে  শ্রদ্ধা জানানো  তার বহুদিনের অর্জিত অভ্যাস। মূলত  শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণবগণের বসবাস এই  বাংলাতে। রামপুরে একটি মাত্র সূর্য মন্দির আছে ।দাসপুরের অন্য কোথাও সূর্য মন্দির নেই। নিমতলায়  গুঁই বাড়িতে মুদ্রায় পূজিত রামসীতা মন্দিরে,  সুরতপুরে হাজারিদের ভগ্ন পঞ্চরত্ন  রামন্দিরে ( ১৭৫৫ খ্রিঃ ), নাড়াজোলের  রাজবাড়িতে দাসপুরে একমাত্র  চুনার পাথরে নির্মিত  রামমন্দিরে ( ১৮১৯ খ্রিঃ )  রামচন্দ্রের পূজো প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে।বহু বাড়িতে রঘুনাথ শিলা আছে। অতি সম্প্রতি শংকরপুরে সীতারামের পাকা মন্দির নির্মিত হয়েছে।    ব্যতিক্রমী  মন্দির জয়কৃষ্ণপুরে প্রদীপ ঘোষেদের পরিত্যক্ত বরাহজীউ লক্ষ্মী    মন্দির ( ১৮৮৪ খ্রিঃ )। চাঁইপাটের ভাবানীপ্রসাদ গোস্বামীর  পারিবারিক  বিশালাক্ষীর দারু বিগ্রহে পুজো এবং দিগম্বর  জৈন মূর্তি পুজো  আর   চাঁপাটের নৃসিংহ মন্দিরে নৃসিংহদেবের পুজো সুপ্রাচীন ।   অভিজাত সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই শাক্ত। দেবী পুজো করে থাকেন। কালী, দুর্গা  , জগদ্ধাত্রী ,সিংহবাহিনী  ইত্যাদি।  লৌকিক দেবদেবী হিসেব  শীতলা মনসা পাঁচু ঠাকুর তথা পাঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ , ষষ্ঠী , ওলাই চণ্ডী, ক্ষেত্রপাল, ধর্মঠাকুর  কালুরায় , নারাণরায়,  দক্ষিণরায়  প্রমুখ সুপরিচিত।     সাধারণ   তথা  জনগণের দেবতা  শিব  সর্বত্র  লিঙ্গাকারে  পূজিত হন। শিবালয়ের প্রতিষ্ঠা বিষয়ে ব্রাহ্মণ কায়স্থ ইত্যাদি  উচ্চ বর্ণের

ভুস্বামীরা কদাচিৎ গুরুত্ব দিয়েছেন ।  দাসপুরের বেশির ভাগ টেরেকোটা সজ্জিত  শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন মাহিষ্য সম্প্রদায়ের ব্যবসাদার বা জমিদার ।   শালগ্রাম শিলায় শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী  বিষ্ণু কল্পিত  হয়ে  বিভিন্ন  নামে  পুজো হয় দাসপুরের সর্বত্র।পরবর্তী কালে চৈতন্যদেবের প্রভাবে  বিষ্ণু  কৃষ্ণ অভেদ রূপে  পূজিত হতে থাকেন। গৌড়ীয়    বৈষ্ণবদের প্রভাবে  বাসুদেব ক্রমে বহু  মানুষের  কাছে রাধাকৃষ্ণের  যুগল মূর্তিতে পরিবর্তিত হয়ে  আরাধ্য  হয়েছেন।
শোনা যায় মেদিনীপুর জেলা শ্রীচৈতন্যের পদধূলি ধন্য  জেলা।  তাঁর কৃষ্ণপ্রেমভক্তি সাধনধারা  প্রবাহে সারা দেশের মত  দাসপুরও ভেসে ছিল । এক সময়ে চৈতন্যকেই কৃষ্ণ রূপে কল্পনা ও পুজো  শুরু হয়ে যায় ।   পরবর্তি কালে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের নির্দেশে কৃষ্ণ প্রাপ্তির উপায় স্বরূপ   চৈতন্যকে নির্দিষ্ট করলে চৈতন্য প্রভাব ক্রমে নিম্নমুখী হতে থাকে। চৈতন্য জীবনীকারেরা চৈতন্যের মধ্যে কৃষ্ণের লীলামাধুরী খুঁজে বেড়িয়েছেন। নরোত্তম দাসের ‘ চৈতন্য মঙ্গল’ থেকে জানা যায়  বাসুদেব সার্বভৌম প্রথম  চৈতন্যের ষড়ভুজ মূর্তি দর্শন করেছেন , এছাড়াও কাশী মিশ্র প্রমুখ  গৌরাঙ্গের ষড়ভুজ রূপ দেখেন। রাম, কৃষ্ণ ও গৌরাঙ্গের  মিলিত বিগ্রহ ষড়ভুজ চৈতন্য । উপরের দুই হাতে  রামচন্দ্রের ধনুর্বাণ , মধ্যের দুই হাতে কৃষ্ণের  মুরলী  ও নীচের দুই হাতে  চৈতন্যের সন্ন্যাসের প্রতীক দণ্ড  কমণ্ডুলু । বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে  শ্যামরায় ( ১৬৪৩ খ্রিঃ ) কেষ্টরায়  ( ১৬৫৫ খ্রিঃ )  এবং মদনমোহনের ( ১৬৯৪ খ্রিঃ ) মন্দির গাত্রে ষড়ভুজ চৈতন্যের মূর্তি দেখা মিললেও দাসপুরে সিংহদের গোপীনাথের ( ১৭১৬ খ্রিঃ) মন্দিরে প্রথম ষড়ভুজ চৈতন্যের টেরেকোটার ফলক দেখা যায়। এছাড়া চাঁইপাটের  রাধাগোবিন্দ  মন্দিরে ( ১৭৯৮  খ্রিঃ )  কোটালপুরে ভূঁইয়াদের শ্রীধরের পঞ্চরত্ন মন্দিরে ( ১৮১৫ খ্রিঃ) অতিসম্প্রতি কোটালপুরের টেরেকোটা সমস্ত ফলক ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে ।  গোছাতির মাইতিদের সন তারিখহীন  সতেরো চূড়া রাসমঞ্চের পূর্বদিকে দাসপুরের

সবথেকে বড় পোড়ামাটির ষড়ভুজ চৈতন্য আছে , কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়  ধর্মোন্মাদদের বিকৃত মানসিকতায় দাসপুরের বহু মন্দিরের মত এখানেও মূর্তির মুণ্ডটি ভাঙা হয়েছে ।   সামাটের মদনগোপাল দালানে ( ১৮২৮ খ্রিঃ )  আজুড়িয়ার চরণদের  লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে (১৮৭১ খ্রিঃ) রামদাসপুরে দুর্গাপদ মাইতিদের দধিবামন পঞ্চরত্ন (১৮৩৪ খ্রি: )  পূর্বমুখী মন্দিরের মূল রত্নে, নাড়াজোলের রাজবাড়ির জয়দুর্গা মন্দিরে , শ্রীধরপুরে সামন্তদের রঘুনাথের দরজার বাম  দাঁড়াতে   ষড়ভুজ চৈতন্য ফলক আছে। কেবলমাত্র মন্দির ফলকে নয়, তিনশতাধিক বছরের বহু পূর্ব   থেকে নিমতলার শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সম্প্রদায়ের অস্থলে দারুমূর্তি ষড়ভুজ চৈতন্য সপার্ষদ পূজিত হয়ে আসছেন। নিমতলারই তমাল হড় গোস্বামীর বাড়িতেও দারুমূর্তি ষড়ভুজ চৈতন্য , নিত্যানন্দ ও ষড় গোস্বামী নিত্য আরাধিত হচ্ছেন।কাদিলপুরে দত্তদের মন্দির(১৮০০ খ্রিঃ)  পোড়ামাটির  ফলকে গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ সহ ষড় গোস্বামীর দেখা মিলবে সামাটের অস্থল , চাঁইপাটের রাধাগোবিন্দ মন্দির , দাসপুরে পালেদের মন্দির,লাওদার বালিয়ালদের মন্দিরে , শ্রীধরপুরে সামন্তদের মন্দিরে , চাঁইপাটের রাজরাজেশ্বর মন্দির সহ অন্যান্য বহু মন্দিরে  গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ দেখা যাবে।    বাসুদেবপুরের চক্রবর্তীদের মহাপ্রভু নবরত্ন মন্দির (১৮৩২ খ্রিঃ ) সাম্প্রতিক কালে ধ্বংস সাধন করা হয়েছে কেবল গৌরাঙ্গের দারু বিগ্রহ পূজিত হচ্ছেন ।
রবিদাসপুরের অধিকারীদের কৃষ্ণবলরাম মন্দিরে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির কৃষ্ণ বলরামের  দারুমূর্তি দ্বয়  চৈতন্য প্রভাব এড়িয়ে আজও  আরাধিত হয়ে চলেছেন। জয়রাম চকের শ্রীমন্দিরে রাধা কৃষ্ণসহ গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দ  ,  বড় শিমুলিয়ার আনন্দ আশ্রমে রাধাকৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ  নিত্যানন্দ, গৌরার গৌরগোপাল ধামে নাড়ুগোপাল , সেকেন্দারীর রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে , পদমপুরে গুঁইদের নন্দদুলাল মন্দিরে , সাগর পুরে  রাধামাধবের মন্দির ইত্যাদিতে  রাধাকৃষ্ণ সহ গৌরাঙ্গ নিত্যানন্দের আরাধনা দাসপুরের শ্রীকৃষ্ণ ও চৈতন্য আরাধনার  ধারাবাহিকতার  উজ্জ্বল নিদর্শন ।    দাসপুরের  গ্রামে  গ্রামে  লৌকিকদেবী শীতলা, মনসা, চণ্ডী, ধর্ম ঠাকুর ইত্যাদির বহু পাকা  মন্দির  থাকলেও  তাতে  টেরেকোটার কাজ  নামমাত্র আছে বা নেই।কেবলমাত্র  সুরতপুরের  শীতলা মন্দিরটি   ব্যতিক্রমী।  এখানকার  টেরেকোটা শোভিত মন্দিরের অধিকাংশই  বিষ্ণুরূপী শালগ্রাম শিলার।  কৃষ্ণবলরাম, শিব, শীতলার  মন্দির  গুটিকয়েক। হিন্দুদের  মুখে মুখে  তিন দেবতার  নাম উচ্চারিত হয়।  সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু,মহেশ্বর।দাসপুরের  মন্দির  অলংকরণে  তিন  দেবতা তেমন  ভাবে  স্থান করে  নিতে  পারেননি। সবাহন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর লাওদার বালিয়ালদের বাঁকারায়ের মন্দিরে,  দাসপুরের  পালেদের মন্দিরে,   রামনগরের শীতলানন্দ শিব  মন্দিরে, দেবকুলে  গোস্বামীদের মন্দিরে ,  নিমতলার গুঁইদের  আর পলশপাইয়ের রঘুরাম   মন্দির ,হরিরামপুরে শীতলানন্দ মন্দিরে আছেন। পলশপাইয়ের রঘুরাম মন্দিরে   অন্যান্য দেবতার সঙ্গে  ইন্দ্র যম আছে।
বর্তমানে বাঙালির সব থেকে বড় উৎসব দুর্গোৎসব । মন্দির ভাস্কর্যে দেবী দুর্গার স্থান হবে না এ হতে পারে না । দাসপুরের বেশ কিছু মন্দিরে দেবী দুর্গা স্থান করে নিয়েছেন ।   চেঁচুয়া  গোবিন্দনগরের গোস্বামীদের  রাধারমণ  ও রাধাগোবিন্দ মন্দিরে ( ১৭৮১ খ্রিঃ )  সপরিবারে দেবী দুর্গা স্থান  পেয়েছেন, সঙ্গে জয়া বিজয়া। দাসপুরে পালেদের লক্ষ্মীজনার্দন  মন্দিরে ( ১৭৯১ খ্রিঃ )  ও  পলশপাইয়ের গোবিন্দরাম   মাইতির রঘুরাম  মন্দিরে ( ১৮৩৭ খ্রিঃ) কেবল দুর্গা, পৃথক ফলকে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ আছে , ব্রাহ্মণবসানে মণ্ডলদের রঘুনাথের মন্দিরে, গোছাতির মাইতিদের সতেরো চূড়া রাসমঞ্চে ( অতি সাম্প্রতিককালে মূর্তি চোরেরা দুর্গা মূর্তিটি চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। পুত্র কন্যারা রয়ে গিয়েছেন) ,  সৌলানে  অধিকারীদের শ্যামসুন্দর মন্দিরে,  সিংহে চড়ে দ্বিভুজা  দুর্গা ও মহিষে উপবিষ্ট মহিষাসুরের মধ্যে  যুদ্ধের ফলক আছে মন্দিরের পশ্চিম দিকের খিলানের উপরে।  এখানেই  শ্যামসুন্দরের নবরত্ন রাসমঞ্চে কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী সহ  দুর্গা আছেন। রাধাকান্তপুরের গোপীনাথের মন্দির সংস্কার হয়েছে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে । এই সময়ে  মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিটি লাগানো হয়েছে বলে অনুমান করা যেতে পারে। । সুরতপুরের কাছে খোর্দা বিষ্ণুপুর গ্রামে পরিত্যক্ত  রঘুনাথের পঞ্চচূড়া  মন্দিরে প্রবেশ পথের উপর  রামচন্দ্রের  কেবল দেবী দুর্গার অকাল বোধনের পূজা আছে। ডিহিবলিহার পুরে রাসবিহারী চক্রবর্তীর  ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে  প্রতিষ্ঠিত দধিবামনের দক্ষিণমুখী পরিত্যক্ত  পঞ্চরত্নমন্দিরে কেবল মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা আছে।  সুরতপুরের শীতলা মন্দিরে (১৮৪৯ খ্রি ) কেবল দুর্গা , হরিরামপুরের শীতলানন্দ শিব মন্দিরে জয়া বিজয়া সহ দুর্গা মূর্তি আছে। নাড়াজোলের জয়দুর্গার পূর্বমুখী  মন্দিরে  দক্ষিণ দিকে মহিষাসুর বধোদ্যত দুর্গার টেরেকোটা আছে।  দুর্গা পুজো  খুব ব্যয় সাধ্য । দাসপুরের এতগুলো মন্দিরে দুর্গার টেরেকোটা ফলক দেখে সহজেই অনুমান করা যেতে পারে যে , এক সময়ে দাসপুরে বহু সম্পদশালী ব্যক্তির বসবাস ছিল। তাদের বাড়িতে দুর্গোৎসব  হত।
ইদানিং দেবী কালীর আরাধনা ক্রমবর্ধমান হলেও সেকালের  মন্দির গাত্রে দেবী সেইভাবে স্থান করে নিতে পারেননি । রামনগরের শীতলানন্দ শিব মন্দিরে, দাসপুরে পালেদের মন্দিরে শৃগাল সহ এবং সৌলানে শ্যামসুন্দর মন্দিরে ছাড়া আর কোথাও একক কালী চোখে পড়েনি। জটিলা কুটিলার সামনে কৃষ্ণের কালী মূর্তি ধারণের ফলক আছে গোবিন্দনগরে রাধারমণ মন্দিরে, চাঁইপাটের রাজরাজেশ্বর মন্দিরে, আজুড়িয়ার  চরণদের মন্দিরে, রবিদাসপুরে অধিকারীদের কৃষ্ণবলরাম মন্দিরে রামদাসপুরের মাইতিদের দধিবামন মন্দিরে     আর গোছাতির মাইতিদের রাসমঞ্চে।   ভিক্ষুক শিবকে অন্নপূর্ণার ভিক্ষা দানের ফলক আছে রামনগরের শীতলানন্দ শিব মন্দিরে ।   উত্তর গোবিন্দনগরের ভুবনশ্বর মন্দিরে সখি পরিবৃতা অন্নপূর্ণা ভিক্ষুক শিবকে ভিক্ষা দিচ্ছেন আর পলশপাইয়ের মাইতিদের রঘুরামের   (১৮৩৭ খ্রিঃ )  মন্দিরে  পায়ে খাড়ু মাথায়  বিসদৃশ খোঁপা নিয়ে ভিক্ষাদাতা অন্নপূর্ণা  ও অহিভূষণ   প্রার্থী শিব । হরিরামপুরে শিশু গণেশকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মহাদেব , পলশপাইয়ের রঘুরাম মন্দিরে শিশু  গণেশ শুঁড় দিয়ে  পার্বতীর  স্তন্যপান করছে এমন ব্যতিক্রমী ফলক আছে। উত্তর গোবিন্দনগরের ভুবনেশ্বর মন্দিরে  বিবাহ সভায়  হিমালয় পত্নী মেনকা জামাই বরণ করার সময় শিব দিগম্বর  হয়ে পড়েন। এই দৃশ্য দেখে মেনকার মুখের সলজ্জ হাসি , দাসীরা লজ্জায় অধবদনের যে চিত্র   অসাধারণ দক্ষতায় শিল্পী  ফুটিয়ে তুলেছেন তা দেখার মত। আবার একই ঘটনার ফলকে শ্রীধরপুরে রঘুনাথের মন্দিরে মেনকা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সঙ্গে থাকা এয়োদের সলজ্জ হাসি দর্শককে মুগ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। ।   যেন চলচ্চিত্রের পর পর  দুটি দৃশ্য।
দাসপুরের মন্দির গাত্রে  রামায়ণের  কাহিনী সব থেকে  বেশি গুরুত্ব  পেয়েছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ কাহিনীর চরিত্রগুলিতে  বাঙালিয়ানার  ছাপ এত সুস্পষ্ট  যে, বাঙালি রামায়ণ    পড়ার  সময়, পাঠ শোনার  সময়  নিজের সুখ দুঃখ  , আনন্দ বেদনা, পরিবার পরিজন ও সমাজকে দেখেছে। কৃত্তিবাস ওঝার  রামায়ণ পাঁচালি  মধ্যযুগীয় বাঙালির  জীবনধারাকে  কতদূর  প্রভাবিত  করেছিল  তার  নজির ছড়িয়ে আছে বাঙালির রচিত সেই সময়কার সাহিত্যে এমনকি  মন্দিরের অলংকরণেও।  অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাংলা সাহিত্যের  ইতিহাসে লিখেছেন, ” মূল রামায়ণের বীর রামচরিত্র কৃত্তিবাসী রামায়ণে ভক্তের ভগবানে পরিণত হয়েছেন, ক্ষত্রিয়বধূ  সীতা হয়েছেন সর্বংসহা  বাঙালী কুলবধূ, হনুমানের রঙ্গরস প্রভৃতিও বাঙালী সংস্কৃতিরই  পরিচায়ক।”   দাসপুরের  টেরেকোটা ফলক শোভিত  মন্দিরে  মারীচ বধ প্রায়  প্রতিটিতে  আছে।  মারীচ অধিকাংশ  মন্দিরে অর্ধেক  নারী  অর্ধেক  হরিণ । কেবল  গৌরার  হাঁড়াদের  লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরের মারীচটি  পুরুষ। সীতা হরণ করে ফেরার পথে  রাবণকে জটায়ু বাধা দেয়, রাবণ তার ডানা কেটে দেয়। সীতা হরণে জটায়ুর বাধাদান প্রায় সব মন্দিরেই আছে। নারীর লাঞ্ছনা মানুষ যে  ভালো চোখে দেখতনা তার নজির এই টেরাকোটা ফলকে লক্ষ করা যায়। নারী লাঞ্ছিত হলে সাধারণের কী করা উচিত তা দেখিয়ে দিতেই মন্দিরে মন্দিরে জটায়ু।ছদ্মবেশি ভিক্ষুক রাবণের সীতা হরণ , রামরাবণের যুদ্ধ প্রায় সমস্ত মন্দিরেই আছে।   রাধাকান্তপুরের দত্তদের মন্দিরে রাবণ সেনা মাথায় বাঙালিদের পাগড়ি  পরে আছে হাতে তরবারি । অধিকাংশ   মন্দিরে মূল প্রবেশ দ্বারের উপরে রামসীতা সিংহাসনে বসে আছেন পাশে তিন ভাই , হনুমান ইত্যাদি আছে। দুএকটি মন্দিরে  বানর সেনাকে বন্যপ্রাণী বোঝাতে উলঙ্গ দেখানো হয়েছে। দাসপুরের পালেদের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাতে জয়ঢাক বাব্জানো, হাতি দিয়ে মাড়ানো,  অনুরূপ ফলক আছে ডিহিবলিহারপুরে চক্রবর্তীদের দধিবামন মন্দিরে ।এছাড়াও   শ্রীধরপুরে শ্রীধরজিউর মন্দিরে গাত্রে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ, চাঁইপাটের নায়েকদের , চেঁচুয়া গোবিন্দনগরের  গোস্বামীদের , কাদিলপুরের দত্তদের মন্দিরে কুম্ভকর্ণের বানর সেনা ভক্ষণের ফলক আছে । লক্ষ্মণের শক্তিশেলের ফলক আছে চেঁচুয়া  গোবিন্দনগরে গোস্বামীদের মন্দিরে, দাসপুরের পালেদের মন্দিরে   সৌলানের অধিকারীদের মন্দিরে, রাধাকান্তপুরে  মণ্ডলদের রামেশ্বর মন্দিরে , গোবিন্দনগরের ভুবনেশ্বর  মন্দিরে। গৌরার   হাঁড়াদের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে( ১৮২৪ খ্রিঃ ) ,রাধাকান্তপুরে রামেশ্বর মন্দিরে ও  ডিহিবলিহারপুরে রাধাগোবিন্দ মন্দিরে ।  প্রচুর বানর সেনা আছে চাঁইপাটের রাধাগোবিন্দ  মন্দিরে। এখানে কর্ণিক হাতে সেতু বন্ধনরত নল ও নীলের দেখা মিলবে।
ব্রাহ্মণবসানে মণ্ডল পরিবারের রঘুনাথ মন্দিরে মূল  প্রবেশ দ্বারের খিলানে দুর্গা ফলকের  উপরে  ডান দিকে অর্জুনের লক্ষভেদের  ফলক আছে । ডিহিবলিহারপুরে চক্রবর্তীদের  দধিবামন  মন্দিরে  মূল প্রবেশ দ্বারের    খিলানের উপরে  শরশয্যায় শায়িত পিতামহ ভীষ্মকে  অর্জুনের  জলপান করানোর ফলক আছে।   দাসপুরে পালেদের মন্দিরে , পলশপাইয়র রঘুরাম মন্দিরে ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের ফলক, রামদাসপুরে মাইতি পরিবারের পঞ্চরত্ন দধিবামন মন্দিরে অর্জুনের লক্ষভেদের ফলক ছিল, সাগরপুরে হাইতদের দামোদর মন্দিরে ভীম ও  দুর্যোধনের যুদ্ধের ফলক  ছিল  এ    ছাড়া  দাসপুরে  আর কোথাও প্রাচীন মন্দিরে  মহাভারতের কাহিনি নজরে পড়েনি।
দাসপুরের  নব নির্মিত  মন্দিরগুলিতে মহাভারতের  কাহিনি স্থান পেয়েছে। সিঙাঘাইয়ের  কল্যাণেশ্বরী কালী  মন্দিরে দেয়ালের গায়ে  কর্ণের  রথচক্র  মাটিতে প্রবেশ করেছে অর্জুন  কর্ণ বধে উদ্যত হয়েছে এমন একটি দৃশ্য স্থান পেয়েছে।  নিজেদের মধ্যে তথা ভায়ের সঙ্গে ভায়ের  জীবিকার জন্য রক্তক্ষয়ী লড়াই  কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধকে ও বর্তমানে  ভাগ্য বিড়ম্বিত যুব  সম্প্রদায় কর্ণের মধ্য  নিজের  চরিত্রের  সাদৃশ্য  খুঁজে  পায়।  তাই  মন্দিরের  গায়ে  আত্ম  দর্শন হচ্ছে ।  জয়রাম  চকের  মহাপ্রডুর মন্দিরে, সাগরপুরের  চাঁপীর অশ্বত্থতলার রাধামাধব  মন্দির বরুণার জনকল্যাণ সেবা আশ্রমের  মন্দির  সহ অন্যান্য  মন্দিরে মহাভারতের  কাহিনি  স্থান  পেয়েছে। রামায়ণের  সৌভ্রাতৃত্ব  অপেক্ষা মহাভারতের  ভ্রাতৃ বিদ্বেষ আধুনিক  যুগে বেশি এই জন্য  নাকি  শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা  পাঠ  বাড়ছে  বলে  মহাভারতের  প্রতি মানুষের  আগ্রহ  বেড়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা  যেত পারে  যে,  চৈতন্যদেবের  বহু পূর্ব থেকে  বাংলায়  রাধাকৃষ্ণতত্ব  প্রচলিত  ছিল। শক্তি সাধনার তীর্থ ক্ষেত্র বীরভূম  হলেও  এখানে কেঁদুলিতে জয়দেব গোস্বামী  তাঁর ‘গীতগোবিন্দ ‘ রচনা  করেছেন। সরল সংস্কৃতে লেখা ‘গীতগোবিন্দ ‘ বাংলার   ঘরে ঘরে  সমাদৃত  হয়েছে।   প্রাকচৈতন্য  জয়দেব, বড়ুচণ্ডীদাস , চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতির  পদাবলী  রসাস্বাদনে  বাঙালি অভ্যস্ত ছিল। পরবর্তী কালে  রাধাকৃষ্ণের উপাসনা  রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তিধর্মের প্রভাবে  ব্যাপকভাবে  সারা বাংলাদেশ ছড়িয়ে  পড়ে। ফলে মহাভারতের বীর ক্ষত্রিয় কৃষ্ণ  কাহিনীর  স্থান  পায়নি  মন্দিরগুলিতে।  রাধাকৃষ্ণের কাহিনী স্থান পেয়েছে  বিষ্ণু মন্দিরগুলিতে  তো বটেই এমনকি  শিব, শীতলার  মন্দিরেও।   আধুনিক যুগের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার  সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয় ফলকগুলি আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে অবিরত।   কৃষ্ণের  বাল্যকাল , পুতনা বধ, বড়াই সহ পসরা নিয়ে গোপিনী ,  কালীয় নাগ দমন,  নৌকাবিলাস,বস্ত্র হরণ,  রাধাকৃষ্ণলীলা,   কৃষ্ণের কালী মূর্তি ধারণইত্যাদি মন্দিরগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে  আছে । কেবল মাত্র সৌলানের অধিকারীদের মন্দিরে কংস ভগবতীকে আছড়ে মারছে, বসুদেব নবজাতক কৃষ্ণকে মাথায়  করে নিয়ে যাচ্ছে এমন ফলক আছে।  রামায়ণের কাহিনির পরেই জনসমাজে সমাদৃত কৃষ্ণ কথা। ভাগবতের কৃষ্ণ অপেক্ষা কবি জয়দেবের , বড়ুচণ্ডীদাসের কৃষ্ণ কাহিনি জনতার প্রিয় ছিল।
বৈদিক ঋষিরাও  সমাজকে অস্বীকার করতে পারেননি । তাঁদের রচিত বৈদিকমন্ত্রেও  সমাজ প্রতিফলিত  হয়েছে। সাহিত্য  তো সমাজ দর্পন। দাসপুরের  টেরেকোটা ফলক শোভিত দেবদেবীর  মন্দির গাত্রে ধর্মীয় বিষয় যেমন স্থান পেয়েছে তেমনি তৎকালের সমাজের ছবিও প্রতিফলিত হয়েছে। দাসপুরের অধিকাংশ  মন্দির  বণিক  সম্প্রদায় ও জমিদার পর্যায়ের মানুষজন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।  স্বভাবত মন্দির  গাত্রে সমাজের  উচ্চ  শ্রেণির জীবনযাত্রার  ছবিই বেশি  স্থান  পেয়েছে।   বণিক ও জমিদারদের সঙ্গে কৃষক  সম্প্রদায়ের সম্পর্ক  ভাল ছিল  না।  তাই  কোন  মন্দিরে  কৃষক  বা কৃষি সংক্রান্ত  একটিও ফলক  নেই।   এমনকী  লৌকিকদেবীর  সেই ভাবে  স্থান  হয়নি ।   এক সময়ে দাসপুরে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে বহু  মানুষের  মৃত্যু  হত। তাই প্রচলিত বিশ্বাস মত বসন্ত রোগের দেবী শীতলাকে তুষ্ট করার জন্য  প্রায় প্রতিটি গ্রামে শীতলা  পূজিত হয়ে আসছেন ।  লক্ষণীয়  বিষয় হল শীতলার বাৎসরিক পুজো দেশ পুজো নামে পরিচিত। ইনি গ্রাম্যদেবী গ্রামের দেবী । দেশ পুজোতে শীতলা মঙ্গল গান বাধ্যতা মূলক।  পুর্ব মেদিনীপুর জেলার  কোলাঘাটের কাছে কানাইচক গ্রাম শীতলা মঙ্গলের  বিখ্যাত কবি কবি নিত্যানন্দ চক্রবর্তীর বাসভুমি   আর  এক বিখ্যাত কবি রামেশ্বর চক্রবর্তী জন্মেছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের  খড়ারের কাছে যদুপুরে।  এই দুই কবির  শীতলা মঙ্গল দাসপুরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।  দেশ পুজো সাধারণত  ফাল্গুন চৈত্র  বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ  মাসেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । এই সময়ে বেশি গুটি বসন্ত হত।
কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল ,     প্রায়  প্রতি  গ্রামে  শীতলা  পঞ্চানন্দ  মনসা  থাকলেও  কেবল রামনগরের পঞ্চরত্ন  ‘শীতলানন্দ’ শিব মন্দিরে উত্তর দিকের  প্রবেশ  পথের  উপর হেঁতালের লাঠি  হাতে  চাঁদ সওদাগর সহ মনসা,  শীতলামঙ্গল গানের   বিরাট   রাজার  কাহিনীর  পুত্রদ্বয় সহ রানি ও সবাহন সম্মার্জনী  হাতে শীতলা দেবী আছেন । দাসপুরের  অন্য  কোন  মন্দিরে এঁদের  স্থান  হয়নি ।এমনকী  সুরতপুরের  শীতলা  মন্দিরে  বহু  টেরেকোটা ফলকের  মধ্যে  শীতলা মনসা  অনুপস্থিত।  প্রসঙ্গত  উল্লেখ করা  যেতে  পারে,  অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ মন্দির- ভাস্কর্যে  প্রতিফলিত সমাজচিত্র ‘ প্রবন্ধে লিখেছেন, ” ক্ষেত্রানুসন্ধানকালে  বীরভূম  জেলার ইটণ্ডাগ্রামের  এক পরিত্যক্ত  জোড়বাংলা কালী মন্দিরের  সামনের  দেওয়ালে  দুটি মাত্র মনসা ফলক ছাড়া  আর কোন লৌকিক দেবদেবীর  প্রতিরূপ আমরা কুত্রাপি দেখিনি। ”    কিন্তু  অভিজাত ব্যবসাদারেরা সযত্নে মন্দির ফলকে চণ্ডীমঙ্গলের কমলে কামিনী দর্শন, ধনপতির বাণিজ্য যাত্রা স্থান দিয়েছেন ।  অতীতকালে বাংলার বণিক বাণিজ্যতরী নিয়ে সমুদ্রে ভাসতেন  তার প্রতিফলন হয়েছে মন্দির গাত্রে। এ প্রসঙ্গে  উল্লেখ করা যেতে পারে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের শক্তিশালী কবি  মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মেদিনীপুরে তাঁর ‘ চণ্ডীমঙ্গল’  কাব্য রচনা করেছেন।  কাব্যটি এই এলাকায় বিপুল জনপ্রিয়তা  অর্জন করেছিল ।  শিব মঙ্গল কাবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি রামেশ্বর চক্রবর্তী বসবাস করতেন  দাসপুরের অদূরে যদুপুর গ্রামে। তাঁর রচিত ‘ শিবায়ন’ কাব্য কী নিম্নবিত্ত কী উচ্চবিত্ত সকলের মন জয় করতে পেরেছিল।  দাসপুরের প্রায় সমস্ত মন্দিরে চণ্ডী মঙ্গলের ধনপতির  কমলেকামিনী  দেখা যায় ।    শিবমঙ্গল  কাব্যের কাহিনি   সমাদৃত  হয়ে  মন্দির ফলকে স্থান করে নিয়েছে।  প্রসঙ্গত বলা যায় আমরা কম বেশি সবাই জানি চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের  অন্য একটি কাহিনী কালকেতু ফুল্লরার কাহিনি ।  কালকেতু ব্যাধ সন্তান, দেবী চণ্ডীর বরে রাজা  হয়েছিল । এই যে তথাকথিত নিম্ন জাতির মানুষের রাজা হওয়া সেটা উচ্চবর্ণের মানুষজন  এমনকি মাহিষ্য জাতির বড় বড় ব্যবসায়ীরাও  মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদের   প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে  কালকেতু ফুল্লরার স্থান হয়ে ওঠেনি ।        গোপালপুরের  চক্রবর্তীদের গগনেশ্বর(১৭০৭ শকাব্দ) শিব  মন্দিরে দ্বারপাল  হিসেবে  দুই নগ্ন মূর্তি  জৈন  সাধুদের  কথা  মনে  করিয়ে  দেয়। প্রসঙ্গত বলা  যেতে  অদূরে  পান্না( < পটনা ) থেকে  জৈন ধর্মের বেশ কিছু নিদর্শন  পাওয়া গিয়েছে। এই বিষয়ে  গবেষকগণ  ভেবে  দেখতে পারেন।
দাসপুরে  পালেদের ‘লক্ষ্মীজনার্দন ‘ ও শ্রীধরপুরের  সামন্তদের ‘রঘুনাথজীউর’  মন্দির টেরেকোটা ভাস্কর্যে  স্থান পেয়েছে  গোপালন, গাভী দোহন, বাঁক  করে  দুগ্ধজাত সামগ্রী পরিবহন। বাঁকে করে কিছু বহনের ফলক আছে আজুড়িয়ার লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে। দাসপুরের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে  সুতো কাটছে এক মহিলা, ছাগলকে  পাতা  খাওয়াচ্ছে  এক মহিলা, সম্ভবত  ছাগলের চাষ অনেকের জীবিকা ছিল।এক পুরোহিত  ঘন্টা  বাজিয়ে  শিবলিঙ্গের  আরতি  করছেন। একজন ঝাঁঝ বাজাচ্ছে। গোছাতির রাসমঞ্চেও  শিবলিঙ্গে ঘন্টা বাজিয়ে   পুজো করছেন এক পুরোহিত।   মন্দিরে  পুজোর জন্য  , মন্দির পরিস্কার করার জন্য  ঢাক ইত্যাদি বাজানোর  জন্য  জমি  দেওয়া থাকত। রাধাকান্তপুরে দাসেদের ‘গোপীনাথ মন্দিরে’ খেজুর গাছে  রস পাড়তে  উঠছে  শিউলি। কামার  শালায়  হাপর সহ   কর্মরত  দুই শ্রমিক। সুরতপুরের  ‘শীতলা মন্দিরে’  খেজুর গাছ   থেকে খেজুর  ,তালগাছ থেকে তাল  পাড়তে উঠছে  গেছাল, শ্রীধরপুরের রঘুনাথজীউর  মন্দিরে গেছালের  ডাব পাড়ার  ফলক  স্থান  পেয়েছে।  পাখি  খাঁচায়  নিয়ে  একজনকে  দেখা  যায়  ফলকে।  ভাগ্যগণক বলেই  মনে হয়। শুক পাখি নিয়ে  ভাগ্যগণিয়ে  জীবিকা  অর্জন করত।   বারাঙ্গনাদের  দেখা  যাবে  মন্দির  ফলকে।উত্তর গোবিন্দনগরের ভুবনেশ্বর মন্দিরে পাখার বাতাস রত  দুই দাসীর দেখতে পাওয়া যাবে।
শহর  থেকে দূরে প্রত্যন্ত গ্রামের মন্দিরেও  বিভিন্ন  যানবাহন  স্থান  করে  নিয়েছে। দাসপুরের গোপীনাথ মন্দিরে চার বাহক সহ তাঞ্জাম ,  দশচাকার মকরমুখী  রথ ও পণ্যবাহী নৌকা  আছে।    রাধাকান্তপুরে গোপীনাথ মন্দিরে  একটি ফলকে, গোরুর গাড়ি, তাঞ্জাম, ঘোড়া, ঘোড়ায় টানা  চারচাকার গাড়ি,  বাবু বিলাসের  বজরা,   চাঁইপাটের নায়েক পাড়ার ‘রাধাগোবিন্দের  মন্দিরে’ তাঞ্জামে  পদস্থ  সরকারি কর্মচারী,বিদেশি পোশাক  পরা  নগ্নপদ  বাহক। চেঁচুয়া গোবিন্দনগরে গোস্বামীদের  ‘রাধাগোবিন্দজিউ ‘ মন্দিরে তাঞ্জাম  আছে। হাতির  উপর  বসে আছে এক পদস্থ কেউ তার আগে  পিছে  বন্দুকধারী  চারজন। রামনগরের শীতলানন্দ শিব মন্দিরে  ঘোড়ায় টানা  এক্কাগাড়ি ও পালকি  আছে।  চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের  ধনপতি ও শ্রীমন্তের  নৌবাণিজ্যের কাহিনি  মন্দির গাত্রে  সজ্জিত  করতে  গিয়ে  প্রায়  প্রতিটি মন্দিরে  সমুদ্র  যাত্রার উপযুক্ত  বাণিজ্যতরীর  ফলক  দেখা  যাবে।
দাসপুরের মন্দিরগুলির  অধিকাংশই  অষ্টাদশ  শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উনিশ শতকের  মধ্যে  নির্মিত  হয়েছে।  প্রতিটি  মন্দিরে  সৈন্যের  ফলক  অবশ্যই  আছে। সেই  সময়কার রাজনৈতিক  অস্থিরতার প্রতিফলন  হয়েছ মন্দির  অলংকরণের টেরেকোটাতে । সৈন্যদের মধ্যে পোশাকের  বিভাজনে ইংরেজদের সঙ্গে  দেশীয়  সৈন্যের  পার্থক্য  সহজেই  বোঝা যায়।  পদাতিক সৈন্য,  অশ্বারোহী সৈন্য  থাকলেও  কোন  মন্দিরে  গোলন্দাজ  সৈন্য  স্থান পায়নি। তরবারি  হাতে  সৈনিক থেকে  উদ্যত  সঙ্গিন সহ বন্দুক হাতে  বিদেশি  পোষাকের সৈন্য  আছে।  রামনগরের ‘ শীতলানন্দ শিব ‘ মন্দিরে জলদস্যুদের  জাহাজ  আছে  । জাহাজের   গড়ন  হার্মাদের  মত। সৈন্যের মাথায়  কাউবয়  টুপি, মাস্তুলে  ওঠার  দড়ির  মই  আছে। দাসপুরে সিংহদের মন্দিরেও জলদস্যুর জাহাজ আছে।রাধাকান্তপুরে গোপীনাথের মন্দিরে বাণিজ্য তরীতে জল দস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধের ফলক আছে।      দাসপুরের মানুষ নৌবাণিজ্যের সঙ্গে  যুক্ত  ছিল। তাদের  প্রত্যক্ষ  অভিজ্ঞতার  ফসল   মন্দির  গাত্রে  প্রতিফলিত হয়েছে। রামনগরের  মন্দিরে বন্দুক সহ কুচকাওয়াজরত  বিদেশি  পোষাকের একদল  সৈন্য  দেখা  যাবে।   রাধাকান্তপুরের  শঙ্খবণিক  দত্তদের  মন্দিরে বহু বন্দুকধারী  সৈন্যের  দেখা  মিলবে। প্রায়  প্রতিটি  মন্দিরে  মালকোঁছা দিয়ে  কাপড় পরা খালি গায়ের লেঠেলরা  স্থান  পেয়েছে। জমিদার স্থানীয় এবং বণিকরা  আত্মরক্ষা, সম্পদ সুরক্ষার জন্য  ও শাসন কার্য পরিচালনার জন্য  লেঠেল  বাহিনী  রাখতেন।
এখানকার মন্দিরগুলির  নির্মাণ কালে  ইংরেজ  শাসন  যে  কায়েম  হয়ে গিয়েছিল  তা নজির  টেরেকোটার  ফলকে আছে।  পালেদের  লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে সাহেবি পোশাকে প্রভু  ইরেজ  চেয়ারে  বসে আছে আর নবাবি উষ্ণীষ মাথায়  দিয়ে  দাঁড়িয়ে  আছে এক রাজপুরুষ।  চাঁইপাটের নায়েক পাড়ার ‘রাধাগোবিন্দের মন্দিরে  তাঞ্জামে তাকিয়া  ঠেস দিয়ে  চলেছে  কোন এক রাজপুরুষ। পাশে পাশে   চলেছে হুঁকোবরদার  । আবার রাধাকান্তপুরের  গোপীনাথ  মন্দিরে ঘোড়ায় চড়া  অবস্থায়  গড়গড়ার নলে তামাক খাচ্ছেন  এক সম্ভ্রান্ত জন । নীচে গড়গড়া  ধরে আছে ভৃত্য।
এককালে  সমাজের  উচ্চবিত্তের  বীরত্ব ও পৌরুষ  বৃদ্ধি পেত  বন্য পশু শিকার  করে।  জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ির  বৈঠকখানা  বন্য মহিষ, হরিণের  শিং ,বাঘের  চামড়া  দিয়েশোভিত করা হত তাদের বীরত্বের  উদাহরণ  দিতে। এদের  তৈরি মন্দিরে  শিকার করার  ফলক প্রায় আছেই। চাঁইপাটের  রাধাগোবিন্দের  মন্দিরে হাতিতে  এবং  ঘোড়ায় চড়ে  বল্লাম দিয়ে বাঘ  শিকারের  দৃশ্য  আছে। রামনগরের শীতলানন্দ শিবমন্দিরে  ঘোড়ায়  চড়ে  বন্দুক  দিয়ে   সিংহ  শিকারের ফলক আছে। অথচ  আমাদের  এলাকায় সিংহ ছিল না।সঙ্গীর হাতেও বন্দুক। রাধাকান্তপুরের  গোপীনাথ  মন্দিরে বন্দুক  হাতে  দেহরক্ষী  থাকলেও বাঘ শিকার  বল্লাম দিয়েই। দাসপুরের সিংহদের মন্দিরে একটি একক সিংহ স্থান পেয়েছে সম্ভবত প্রতিষ্ঠাতার পদবী সিংহ বলে।
ভারতে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কায়েম  হতেই ইংরেজ শাসকরা  কেমন  অত্যাচারি  হয়েছিল  তার মর্মন্তুদ কাহিনি  মন্দিরগুলির  টেরেকোটার ফলকে  আছে।  সুরতপুরে এক সময়ে রেশম কুঠিতে সাহেবরা বসবাস করতেন। এই গ্রামের অদূরেই শিলাই নদীর একটি ঘাটের নাম আজও  সাহেব ঘাট , অতীতের স্মৃতি বহন করে চলেছে।  সুরতপুরের  শীতলা মন্দিরটি  ইংরেজ আমলের  ৯২  বছর অতিক্রান্ত  হওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা  গ্রামগঞ্জে  ছড়িয়ে  পড়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও নীলকুঠি, রেশমকুঠি স্থাপিত হয়েছে। এই সব কুঠিয়াল সাহেব অধিকাংশই ছিল মদ্যপ ও লম্পট। দেশীয়  আড়কাঠি  মারফত  সুন্দরী মেয়েদের  খবর পৌঁছে যেত সাহেবের  কাছে। সাহেবরা  জোরপূর্বক এদের ধরে  নিয়ে তাদের পশু প্রবৃত্তি তথা ভোগলালসা চরিতার্থ  করত। কোন  বিচার  পেত না  সাধারণ  মানুষ।  ইংরেজদের জন্য  পৃথক আইন  তো ছিলই, বিচারকরাও ছিল  ইংরেজ। স্বভাবতই বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে।  পুলিশ দারোগাকে যমের মত ভয় পেত  সাধারণ  মানুষ।  অভিযোগ  থানা পর্যন্ত যেত না। এছাড়াও  বহু  জমিদার  নিজেরাই ওই চরিত্রের  ছিল  আর যারা  ছিল না  তারা প্রভু ইংরেজকে খুশি করতে এসব  বিষয়ে  চোখ বুজে  থাকত।  ধর্ষিতা মেয়েদের সমাজে  ঠাঁই  হত না। অনেকে  আত্মহত্যা করে  গ্লানির জ্বালা  জুড়াত , না হয় যে সমাজের  মানুষ তাদের রক্ষা করতে  পারেনি  সেই  সমাজের  নিন্দাবিদ্রুপ সহ্য করতে  না পেরে  সমাজ ত্যাগ করে  পতিতাবৃত্তি  অবলম্বন করে বেঁচে মরে থাকত।
সুরতপুরের শীতলা মন্দিরে ফলকে দেখা যাবে এক মহিলা টোপর পরা বরের হাতে কন্যা সম্প্রদান   করছেন। এটি বিবাহের আনন্দ অনুষ্ঠান নয়, মেয়েটিকে সাহেবের লালসার হাত থেকে বাঁচানোর  জন্য  শেষ প্রচেষ্টা। এর পরেই  আমরা  দেখি  পাত্র রাজবন্দী, কতগুলি  রাজপুরুষ  মেয়েটিকে  ধরে  নিয়ে  যাচ্ছে সাহেবের কাছে  । দাসপুরের গ্রামের  মন্দির স্থপতি ও প্রতিষ্ঠিতা  উভয়েই  ভেবেছেন  এই সব হতভাগিনীর কথা।  এতো প্রতিবাদের  ফলক।  প্রসঙ্গত  উল্লেখ করা  যেতে পারে  এই মন্দির প্রতিষ্ঠার এগারো বছর পর দীনবন্ধু মিত্রের ‘ নীলদর্পণ’ নাটক প্রকাশিত হয়েছিল। মন্দিরের  টেরেকোটার লুন্ঠিত নারীই যেন দীনবন্ধুর  ক্ষেত্রমণি  এর পেছনে আছে কোন পদ্মময়রা বা পদ্মময়রানি। নিয়ে  যাওয়া হচ্ছে  রোগ সাহেবের কুঠিতে। এই রকম  একটি   ফলক  আছে  চাঁইপাটের রাজরাজেশ্বরের  মন্দিরে পাখা এবং চামর হাতে পাঁচ দাসী,   অল্প  বয়সী লজ্জাতুরা একটি  মেয়েকে কাছে  আসতে আহ্বান জানাচ্ছে  এক সরকারি  কর্মচারী।  দুই দাসী ফিসফিয়ে  কী যেন  বলছে।  মনে হয় কানপাতলে  তাদের  কথা শোনা যাবে।
তৎকালীন  সমাজে বিনোদনের  ইতিহাস মন্দিরে মন্দিরে  টেরেকোটার ফলকে বিধৃত  হয়ে আছে। শ্রীচৈতন্যের হরিনাম সংকীর্তনে আর নৃত্যে  কেবল  শান্তিপুর ডুবু ডুবু নদে  ভেসে  যায়নি, সারা  বাংলা ভেসে  গিয়েছিল।  শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে দাসপুরের  প্রতিটি মন্দিরে যেমন  সপার্ষদ শ্রীচৈতন্য ও কৃষ্ণ লীলার কাহিনি  স্থান পেয়েছে তেমনি আছে গায়ক ও বাদ্যযন্ত্রের  বাহুল্য।  গায়কের  মধ্যে  কীর্তনীয়া  আছে  আছে  ধ্রুপদী  গায়ক। মহিলা গায়িকা এবং বাদ্যকরও  স্থান  পেয়েছে মন্দির স্থাপত্যে। দাসপুরের টেরেকোটা সমৃদ্ধ মন্দিরগুলি তৎকালের বাদ্যযন্ত্রের  মিউজিয়াম স্বরূপ।  তত,আনদ্ধ, শুষির ও ঘন এই চার প্রকার বাদ্যযন্ত্রেরই ফলক আছে এই মন্দিরগুলিতে।  বিশেষ  করে শ্রীধরপুরের রঘুনাথজীউর মন্দিরটি ও আজুড়িয়ার চরণদের মন্দির ও রাসমঞ্চের  তৎকালের বাদ্যযন্ত্রের  টেরেকোটা ফলকের বাহুল্য দর্শককে  অবাক বিস্ময়ে  সামনে দাঁড় করিয়ে রাখে। বেহালা বাদক, তবলা ও বাঁয়া বাদিকা, গুবগুবী তথা আনন্দলহরী বাদিকা, মন্দিরা বাদক, খোল, পাখোয়াজ,করতাল,খঞ্জনি, ঢোলক , বাঁশি, সানাই, হারমোনিয়াম ,দুন্দুভি সহ মহিলা গায়িকার  দেখা মিলবে। চেঁচুয়াগোবিন্দনগরে  রাধাগোবিন্দের মন্দিরে  একতারা, খোল  সুরথপুরে   শীতলা মন্দিরে রামশিঙা, বীণা, চেঁচুয়া উত্তর গোবিন্দনগরে ভুবনেশ্বর শিব  মন্দিরে সানাই  , লাওদার  চক্রবর্তীদের  অনন্তদেব মন্দিরে সানাই,  সেতার,  বেহালা , মৃদঙ্গ ,চাঁইপাটের মণ্ডলদের  রাজরাজেশ্বরের  মন্দিরে তানপুরা  সঙ্গে  দুই গায়িকা,  দাসপুরের  লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে জয় ঢাক, ঝাঁঝ,ঘন্টা, খোল,  বীন, কাদিলপুরের দত্তদের  রঘুনাথজীউর মন্দিরে ঢাক,  খোল , রাধাকান্তপুরের দত্তদের  পরিত্যক্ত  রঘুনাথজীউর মন্দিরে  বীণা আছে।  তিনশো বছরের পূর্বেও দাসপুরে খোল ও মৃদঙ্গ বাদিকার অভাব ছিলনা । দাসপুরের  গোপীনাথের  মন্দিরে এদের দেখা যাবে। বেহালা  রুদ্রবীণা  তানপুরা শিঙা রাম শিঙা ভেঁপু বাঁশি   সহ সংগীতের  আসরে মহিলা নর্তকী ও  শিশু  শিক্ষার্থী আছে।  চৈতন্যদেবের প্রভাবে কেবল কীর্তন নয় নৃত্যও সমাদৃত ছিল সমাজে। সে যুগেও  পুরুষ ও নারী উভয়েই নৃত্য ও গীতে অংশ গ্রহণ করত। শ্রীধরপুরে রঘুনাথের মন্দিরে দামামা কাড়া নাকাড়া রণবাদ্য হিসেবে   ব্যবহার দেখানো আছে ।
সেই  সময়কার  বিনোদনের বেশ কিছু  টেরেকোটার ফলক  আছে।  ধর্মীয়  অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক বিনোদনে সব চেয়ে  আগে  রথযাত্রার  ফলক।  উত্তর গৌরার   লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে রথ  টানছে  পুরুষেরা মেয়েরাও  এসেছে। আবার চাঁইপাটের  রাজরাজেশ্বরের মন্দিরে  পুরুষ    রথ টানছে এক সন্তান কোলে নিয়ে  আর এক  সন্তানকে  হাত ধরে  রথ দেখাতে এসেছে এক জননী। ঈশ্বর তথা জগন্নাথের রথ  আপামর জনসাধারণের পবিত্র স্পর্শে চলে । এখানে কেউ ছোট বড় নেই। রাধাকান্তপুরে দত্তদের পরিত্যক্ত রঘুনাথজীউর  মন্দিরে রথ টানার  ফলক  আছে। গোপীনাথ মন্দিরে চড়কের  দৃশ্য  আছে। চেঁচুয়া গোবিন্দনগরের রাধাগোবিন্দের মন্দিরে  ভালুক খেলানোর ফলক, শ্রীধরপুরের রঘুনাথজীউর মন্দিরে  ও  চরণদের মন্দিরে হাতি ঘোড়ার নাচ   দেখাচ্ছে  দুজন।  ছেলে ভুলানো ছড়ার ‘হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে কদম তলায় কে?’  এর হাতি ঘোড়া কিনা জানিনা ।  প্রায় প্রতিটি মন্দিরে  মালা কোঁছা দেওয়া কুস্তিগিরকে  বিভিন্ন  ভঙ্গিমাতে দেখা যাবে। মনে হয় এককালে  কুস্তি করা  দাসপুরে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। চরণ ও  পালেদের  লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরে যোগব্যায়ামের বেশ কিছু সংখ্যক ফলক আছে।  এক মহিলা  যোগব্যায়াম অনুশীলন করছে এমন  ফলক আছে।
দাসপুরের মন্দিরগুলিতে  পারিবারিক  দৃশ্যের টেরেকোটা  ফলকের প্রচুর দেখা  মিলবে।  কাদিলপুরের  রঘুনাথজীউর  মন্দিরে এক মা তার  সন্তানকে  কোলে নিয়ে  চাঁদ দেখাচ্ছে।  মা যেন  বলছে, আয় চাঁদ, আয় চাঁদ যাদুর কপালে টিই দিয়ে  যা। রাধাকান্তপুরের  মণ্ডলদের  রামেশ্বর মন্দিরে এক মহিলা  অন্য  এক মহিলার  চুলের বেঁধে  দিচ্ছে,কোলের কাছে  বসে  এক শিশু, এক মা কলসি কাঁখে জল আনতে  যাচ্ছে সঙ্গী মেয়ে হাতে  ঘটি।  গোবিন্দনগরের রাধাগোবিন্দের মন্দিরে  একটি   কলসী কাঁখে  জল আনতে  যাচ্ছে মা সঙ্গে একটি শিশু। শিশুটি  জামা  পরে  আছে।  এটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী  ফলক।  শিশুরা  আদুড় গায়েই  আছে  অন্যত্র। রামনগরের শীতলানন্দ শিব মন্দিরে এক জননীর মাথায়  ঝড়া  এক শিশু কোলে  অন্যটির হাত ধরেছে মা জানিনা কোন অজ্ঞাত  রামকিঙ্কর বেইজের এই অপূর্ব  সৃষ্টি। চেঁচুয়া গোবিন্দনগরের  রাধাগোবিন্দের মন্দিরে  এক মহিলা  অন্যের  কপালে  সিঁদুর  পরিয়ে  দিচ্ছে।  গোবিন্দনগরের   ভুবনেশ্বর মন্দিরে   দুই  মহিলা  আলাপন রত, পদতলে  এক দাসী বসে।   এক মহিলার  ঘোমটা  টানা।  পূর্বে  গৃহবধূদের পুরুষদের  সামনে তো বটেই  এমনকী শাশুড়ি স্থানীয়দের  সামনেও ঘোমটা  দিতে  হত। বর্তমানে  যা অবলুপ্ত ।এই সামাজিক  প্রথার  ইতিহাস  মন্দির  ফলক সজ্জায় লক্ষ করা যায়।  এক সম্ভ্রান্ত  মহিলার পদ সেবারত দাসীদের  ফলক  এই মন্দিরেই আছে।
প্রায়  প্রতিটি  মন্দিরে সন্তান কোলে  জননী  মূর্তি  আছে,  আছে ঘোলমুথনী সহ ননী তোলার দৃশ্য সঙ্গে ননীচরা বালক কৃষ্ণ ।  সুরতপুরের শীতলা মন্দিরে মহিলাদের  পরস্পরের উকুন বাছার   ফলক  আছে। জননীর যন্ত্রণার  ফলক  আছে  সৌলানের  অধিকারীদের শ্যামসুন্দরজিউর  মন্দিরে।  পুত্রবধূ  পাখিকে  খাবার   খাওয়াতে  ব্যস্ত। উপযুক্ত পুত্রের দল  বৃদ্ধা মাকে  ঘর থেকে  বহিষ্কার  করার  চেষ্টা করছে।
দাসপুরের গোপীনাথ মন্দিরে একটি ত্রিতল বজরার উপরে  শায়িত দুজনের শরীর দলাইমালাই করে দিচ্ছে দুই ভৃত্য , চিবুকে দুহাত রেখে আরাম উপভোগ করছেন দুই বাবু ।       বজরাতে  নাচগানের আসরের ফলক আছে রাধাকান্তপুরের গোপীনাথ মন্দিরে।  বহু মন্দিরে  নর্তকীর ফলক  আছে। উচ্চবিত্ত পরিবারে নাচগানের আসর বসানো বাবু বিলাসের, আভিজাত্যের প্রতীক ছিল।  দুই পত্নী  সহ পুরুষের  ফলক গোবিন্দনগরের  ভুবনেশ্বর মন্দিরে  চাঁইপাটের  রাজরাজেশ্বরের মন্দিরে আছে।  সমাজে তখন  বহুবিবাহ প্রথা  চালু ছিল।
দেবদেবী থেকে  মানব মানবীকে কত যে বেশভূষায় অলংকারে  ভূষিত করেছে টেরেকোটা শিল্পিরা তার ইয়ত্তা নেই। পুরুষের  হাতে  বালা  কানে  দুল আছে ,  দেবতা মাত্রেই গলায় মালা আছে। মেয়েদের গলায় হার  , কানে  দুল,  নাকে  টানা  নথ, হাতে বাজুবন্ধ মানতাসা সহ    নানা  রকমের অলংকার ।  পায়ে নপূর খাড়ু মঞ্জিরা ।  পুরুষদের কুর্তা পিরান ইজের,  কখনো  চাপকান  আবার  কোন কোন মন্দিরে  জোব্বা এবং  পায়ে  নাগরা জুতো পরা পুরুষদের  দেখা  গিয়েছে ।  অনেক মন্দিরে পুরুষের কানে কুণ্ডল আছে।  সৈন্যদের কোথাও  কুর্তা পিরান আবার কোথাও  হাফপ্যান্ট হাফসার্ট মাথায় হেলমেট । সম্ভ্রান্ত পুরুষদের মাথায়  রামমোহনের মত পাগড়ি।  মেয়েরা  যে কেবল  শাড়ি  পরে আছে এমন নয় তারা অনেক মন্দিরে ঘাগরা ব্লাউজ  পরে  আছে। বেশ কিছু মন্দিরে  আধুনিক কেতায়  কাপড় পরেছে  মেয়েরা।  বিশেষ করে  গোবিন্দনগরের ভুবনেশ্বর মন্দিরের(১৮৫০ খ্রিঃ)  মহিলারা ব্লাউজ ও শাড়ি  পরেছে।ব্লাউজ ও শাড়ির  উপর বিভিন্ন  নক্সা  করা আছে। চাঁইপাটের রাজরাজেশ্বরের(১৮২৮ খ্রিঃ) মন্দিরের  মহিলারা  সায়া সহ ব্লাউজ তথা সেমিজ পরে আছে।  চাঁইপাটের রাধাগোবিন্দের (১৭৭২খ্রিঃ) মন্দিরে উপরের আর্চের কোলুঙ্গিতে দরজার পাল্লা   অর্ধেক খুলে  প্রতীক্ষারত এক মহিলা আধুনিক যুগের বাঙালি  মেয়েদের মতই  শাড়ি পরে  দাঁড়িয়ে  আছে।  প্রসঙ্গত  অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মন্দির-ভাস্কর্যে প্রতিফলিত সমাজচিত্র ‘ প্রবন্ধে করা উক্তিটি  স্মরণ করা  যেতে  পারে।তিনি লিখেছেন, ” ভাস্কর্যে বিধৃত শাড়ি পরার ধরন কিন্তু হুবহু একালের বাঙালি মেয়েদের মতো।সেজন্য এ বিশেষ ধরনটি ঠাকুর পরিবারের প্রবর্তিত বলে  যে বিশ্বাস প্রচলিত তা হয়তো সত্য নয়। ” কেশ বিন্যাস  পুরুষদের  বাবরি  চুল। রামচন্দ্রের ক্ষত্রিয়োচিত  আকর্ণ বিস্তৃত গোঁফ । রাবণের  গোঁফ  চন্দন দস্যু  বীরাপ্পানের  গোঁফের  মত।   গোঁফদাড়ি  কামানো  রামচন্দ্রের দেখা মিলবে  গোবিন্দনগরের ভুবনেশ্বর শিব মন্দিরে।  এলোকেশি  মহিলা নেই  কোন মন্দিরে। সূর্পনখা , তাড়কা ও মহিলা মারীচকে  সর্বত্র  এলোকেশি  দেখানো  হয়েছে। চেয়ারে বসা  সাহেব মেমের দেখা মিলবে পলশপাইয়ের রেখ দেউল রীতির বিষ্ণু মন্দিরে পলশপাই  খালের বাঁধের দিকে।
বেশ কয়েকশো বছর  দাসপুর ওড়িশার  অধীন ছিল। তাই এখানকার মন্দিরগুলিতে  ওড়িশার প্রভাব  লক্ষ করা  যায়। প্রায়  প্রতিটি  মন্দিরে  দশাবতারের ফলক  আছে।  সর্বত্র  জগন্নাথ  এক অবতার।  কোথাও  বুদ্ধ স্থান পাননি। এর থেকে  দাসপুর অঞ্চলে যেমন ওড়িশার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তেমনি বৌদ্ধ  বিদ্বেষী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় ।  চাঁইপাটের রাধাগোবিন্দের মন্দিরে  জগন্নাথ সুভদ্রা বলরাম আছেন।  প্রসঙ্গত  বলা যায় চাঁইপাটের  রাধাগোবিন্দ ও নৃসিংহ মন্দির দুটির সেবাইত উৎকল ব্রাহ্মণ  ।   কোনারক, ভুবনেশ্বর ও জগন্নাথ মন্দিরে  মিথুন  মূর্তির প্রাচুর্য আছে। দাসপুরের  প্রতিটি মন্দিরে বিভিন্ন ভঙ্গিমার   মিথুন  মূর্তি আছে। শাস্ত্রীয় প্রচলিত  বিশ্বাস  মন্দিরে মিথুন  মূর্তি থাকলে  বজ্রপতন  হয়  না   ,অশুভ নজর লাগে না।  এই মিথুন দৃশ্যগুলিকে ‘মণি ‘ বলে।   বজ্রপতন রোধে নগ্নিকার  জননাঙ্গ লেহনকারী পুরুষের  ফলকটি  সর্বাধিক  মন্দিরে আছে। সব থেকে  বেশি  মিথুন মূর্তি আছে  লাওদার  অনন্তদেব মন্দিরে। ইন্দ্রিয় সম্ভোগের বিচিত্র ভঙ্গিমার ফলক বিভিন্ন মন্দিরে আছে। রাধাকান্তপুরের গোপীনাথ মন্দিরে আত্মরতি  ,  সমকামী দৃশ্য,  এমনকী   লাওদার বাঁকারায় /অনন্তদেব মন্দিরে পশুর(কুকুর? গোরু ? )    সঙ্গে জটাধারীর   যৌনাচারের দৃশ্য  মন্দিরে  টেরেকোটার ফলকে স্থান পেয়েছে। সোনাখালি বাজারে পঞ্চানন শিবের আটচালা মন্দিরে  ( ১৭৭৩ খ্রিঃ )  সমকামী , পশুমৈথুন  ও মৈথুন দৃশ্যের বেশ কিছু ফলক আছে।   ভাবতে অবাক লাগে  এখন থেকে  দুশো বছর    আগে দেবদেবীর মন্দিরে  জনসাধারণের  জ্ঞাতার্থে সমকামিতার,  আত্মরতি, পশুমৈথুনের   ফলক স্থান করে নিয়েছে।
একসময় দাসপুরের  সূত্রধরদের (ছুতোর)  নামের সুখ্যাতি সারা জেলায় ছড়িয়ে  পড়েছিল   কেবলমাত্র  মন্দির স্থাপত্যে তারা ঈর্ষণীয় দক্ষতা  অর্জন করেছিল তা  নয় কাঠ খোদাই করতেও তারা সুনিপুণ ছিল ।দাসপুরের বহু মন্দিরের  তাদের খোদাই নিপুণতার ও শৈল্পিক দৃষ্টির অনন্য  নিদর্শন হিসেবে  আজ টিকে আছে।  নাড়াজোলের রাজপরিবারের  জয়দুর্গার  মন্দিরের  দরজা, গোবিন্দনগরের  রাধাগোবিন্দের দরজা, দাসপুরের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরের দরজা, কাদিলপুরে রঘুনাথজীউর দরজা, সৌলানের শ্যামসুন্দরজিউর দরজা, রাধাকান্তপুরের  রামেশ্বর শিবের দরজা , রামদাসপুরে মাইতিদের দধিবামন মন্দিরে  রামরাবণের যুদ্ধ  খোদিত সাবেকি দরজা সর্বোপরি শ্রীধরপুরের রঘুনাথজীউর দরজা উল্লেখ করার মত।  এই  দরজাগুলিতে  রামায়ণ কাহিনী, দশাবতারের মূর্তি সহ  নানা দেবদেবীর মূর্তি স্থান  পেয়েছে।বিষয় বৈচিত্র্যে ও  শিল্প নৈপুণ্যে আকর্ষণীয়  দরজা  শ্রীধরপুরের রঘুনাথজীউর।  এটি কেবলমাত্র দাসপুর  নয়  ঘাটাল মহকুমার  দেবদেবীর মন্দিরের থাকা পুরোনো দরজার মধ্যে  শ্রেষ্ঠ  দরজা। পরে আসছি  দরজার  কথায়।  তার  আগে  একটু  অন্য  প্রসঙ্গে দুএক কথা বলে নেওয়া যেতে  পারে।  এক সময়ে দাসপুর  ব্যাপী  বৌদ্ধ ধর্মের  ব্যাপক  প্রসার  হয়েছিল।  অনেক  পণ্ডিত মনে করেন  ধর্ম ঠাকুর  বৌদ্ধ দেবতা।  দাসপুরের বহু গ্রামে ধর্ম  মন্দির  আছে।  অনেকে  মনে করেন  চিতুয়া >চেতুয়া-দাসপুর  কথাটি  এসেছে  চৈত্ত শব্দ  থেকে। তাছাড়া  অনেকের অভিমত, বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান শাখা থেকে  হিন্দুদের  তন্ত্র  প্রভাবিত।
মহাযান  বৌদ্ধ ধর্মে বজ্রতারা  বোধিসত্বপ্রাপ্ত একজন নারী। ইনি বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধের  মর্যাদা পান। তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মে বজ্রতারাই  ‘জেতুসন দোলমা ‘ তিনি সকলের মা,  নির্বাণ জননী। অবলোকিতেশ্বরের  নারী মূর্তি তারা। তারা  একুশ প্রকার।  শুক্ল  তারাই  আমাদের সরস্বতী।  ৮ম শতকে  পালেদের রাজত্ব কালে  বৌদ্ধ তারার পুজো বাংলায় জন প্রিয় হয়। তারার  প্রাচীন  চিত্র ইলোরা গুহাতে আছে। পদ্ম ধারিণী  বজ্রতারার পাথরের মূর্তি ইন্দোনেশিয়ার জাভায় বরবদুরে  পাওয়া গিয়েছে এবং  সংরক্ষিত  হয়েছে।  বজ্রতারা  আট  রকমের  দ্বন্দ্ব  থেকে  মানুষকে রক্ষা করেন।  আট রকম দ্বন্দ্বের  আটটি  প্রতীক  আছে । সিংহ অহংকারের, বুনো হাতি অজ্ঞানের, আগুন ঘৃণা ও ক্রোধের , সাপ ঈর্ষার, বন্ধন  লোভ ও কার্পণ্যের, বন্যা কামনা বাসনার, অপদেবতা ও দানব  দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তির।  বৌদ্ধ তন্ত্রে  দেহ  সম্ভোগ  নিম্ন  কোটির।
শ্রীধরপুরের রঘুনাথজীউর মন্দিরের  দরজার  দাঁড়ার  বাম  ও ডান  পাশে  একেবারে নীচে  সম্ভোগ মূর্তি খোদিত। তার উপরে   এক বলশালী  মূর্তি দুই হাতে  দুই হাতির  শুঁড়, দুই বাহুমূলে চাপা  দুই  সিংহের দৃশ্য   আছে।  আসলে তন্ত্র  সাধনায় কামনার  ঊর্ধ্বে উঠে   অজ্ঞানতা  আর অহংকারকে  জয় করতে  হয়। এর উপরে  ঘোড়ায়  চড়ে  দুন্দুভি বাজাচ্ছে।  দুন্দুভি  নাদ ধ্বনির  প্রতীক ।  এর উপরেই  আছেন পদ্ম  হাতে  বজ্রতারা  নির্বাণের প্রতীক স্বরূপ। যার সঙ্গে  বরবদুরের বজ্রতারার হুবহু মিল।  দাসপুরের  এক  প্রত্যন্ত গ্রামের মন্দিরে  তন্ত্রে  এমন  গোপন  তত্ত্ব  খোদিত  আছে  দেখে  বিস্মিত হতে  হয়।
দাসপুরের মন্দির ফলকে বহু পশুপাখি স্থান পেয়েছে।  গোরুর আধিক্য সর্বাধিক । গোচারণে নিয়ে যাওয়া গোরুর পাল , গাভি দোহন আছে দাসপুরের লক্ষ্মীজনার্দন  ও  কাদিলপুরে দত্তদের বিষ্ণু মন্দিরে , গোপ্রজননের ফলক, গোরুর গাড়ির বলদ ,ভালুক হাতি ,ঘোড়া , বাঘ সিংহ, শেয়াল  এসব আছে।  কোটালপুরের  রঘুনাথ  মন্দিরে সমস্ত টেরেকোটা ফলক বিনষ্ট করে ফেলার পরেও মন্দির শীর্ষে দুইবাঘের মাঝে একটি প্রাণভয়ে ভীত হরিণ এখনো আছে।  রাধাকান্তপুরে গোপীনাথের  মন্দির অপেক্ষা দাসপুরের  গোপীনাথের মন্দিরে রাজহাঁস  সব থেকে বেশি স্থান করে নিয়েছে। ময়ূর ,টিয়াপাখি আছে অনেক দেবালয়ে। দেবদেবীর বাহন হিসেবে সিংহ  ষাঁড় ইঁদুর রাজহাঁস গরুড় পেঁচাও আছে।   চাঁইপাটে তাঞ্জামে চলেছে রাজপুরুষ সঙ্গে চলেছে  প্রভুভক্ত কুকুর  । অনুরূপ ফলক আছে চেঁচুয়া গোবিন্দনগরের রাধারমণ মন্দিরে । দুটিই পোষা কুকুর।
সেযুগে  সিদ্ধির নেশা করা সমাজে চল ছিল। প্রায় সব মন্দিরে সিদ্ধি ঘোঁটার ফলক আছে। হুঁকো কোলকেতে তামাক খাওয়ার ফলক আছে উত্তর গোবিন্দনগরের ভুবনেশ্বর মন্দিরে। ঘোড়সোয়ার এক সম্ভ্রান্তের পাশে পাশে চলেছে হুঁকোবরদার গড়্গড়া হাতে চলেছে  এমন  ফলক  আছে চাঁইপাটের রাধাগোবিন্দ মন্দিরে ।  বজরায় বসে গড়গড়াতে তামাক খাওয়ার ফলক আছে হরিরামপুরে শীতলানন্দ শিব মন্দিরে, তাঞ্জামে চলতে চলতে  গড়গড়াতে তামাক খাওয়া আছে দাসুপুরের গোপীনাথ মন্দিরে , চেঁচুয়া গোবিন্দনগরে । অতি বৃহত গড়গড়ায় সামাক সেবনের ফলক আছে  চেঁচুয়া  গোবিন্দনগরের রাধারমণ মন্দিরে।
রাধাকান্তপুরের গোপীনাথ মন্দিরের সংস্কার কালে (১৮৪৪ খ্রিঃ )  পোড়ামাটির ফলকে যে কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে তা যেমন বড় তেমনি ইতিহাসের অমুল্য বিষয় ।  পরিব্রাজক পঞ্চানন রায় লিপিটি উদ্ধার করে বিষয় বস্তুর অনুসারি  কবিতা রচনা করে লিখিত আকারে তাঁর ‘দাসপুরের ইতিহাস’ গ্রন্থে প্রকাশ করেন। পুরাতাত্ত্বিক প্রণব রায় তাঁর ‘ মেদিনীপুর জেলার প্রত্নসম্পদ’ গ্রন্থে  লিপিটির হুবহু পাঠ তুলে ধরেছেন ।                                                                 “রাধাকান্তপুরে বাস   নাম জনানন্দ দাস
সর্গে বাস এই সেই কারনে ।

                     মহামহাপুণ্যবলে  সপ্ত প্বত্র ক্ষিতি তলে
                          জ্যেস্টপুত্র সামদাস নামে।।
                   জিনি দাতা পুন্যদয় /১ প্রকাসিত মহাসয়
                           মোধ্যম ত্রিতিঅ সহদরে
                   বর্দ্ধমানে পাঠাইআ       গোপিনাথে আনাইআ
                          স্তাপন কোরিল এই ঘরে।।
                   লবাব প্রিথিবিপতি     তার/ ২ ভএ বেস্ত অতি
                          সিমানা ঘেরিআ খোলি গড়
                   দামামা দরজা পরে    জয়চোণ্ডি ক্রিপা বরে
                        পুস্কন্যি খোলিল তার পর।।
                  সন্ধান পাইল যদি     সভা সিং / ৩ হ নরোপোতি
                         এই হেত্ত কড়া না অইসে
                 কম্পবান ক্রোধ ভরে   আঙ্গা দিল ওনুচরে
                         হান সির পদাতিক রোসে ।।
                   বিপক্ষ হইল কাল    কাল হোইল প/৪ রকাল
                          কিছু না জানিল মহাসঅ ।
                  তাহাতে ছেদিল মুণ্ড     দুগগা ডাকে তুণ্ড
                        সুনি রাজা মানিল বিস্বয় ।।
                  কোবিতা কোরিতে তার    এই স্তানে আটা ভার/৫
                          হোইল দুই সতেক বৎসর
                    রিতনিত পিত্রি কিত্তি    ওই বংসে অদ্যাবোদি
                             বন্দনা হোইতেছে সুন্দরঃ ।।
                   আপদ হোইল ইথে    বিক্ষ হোইল মন্দিরেতে
                         সারাইতে সা/৬ দ্ধ নাহি কার
                 নারান দাসের বংসে   মধ্যম বাড়ির অংসে
                         জোজ্ঞেস্বর জোন্মেছিল সার।।
                 সন ১২৫১ সালে     গোষ্ঠির  সোহিত মেলে
                          নানা যুক্তি করে জনে জনে
                কেহ বলে/৭ লআ কর   কেহ বলে একেই সার
                          জোজ্ঞেস্বরের কিছু না লঅ মনে।।
                পিতরি  কিত্তি ডুবাইআ  কেমনে করিব ইহা
                         সারাইব জা থাকে ভাগ্যেতে
                ভদ্রলোকে  ডাকাইআ /৮      হিরু মিস্ত্রি আনাইআ
                         উজ্জোগ করিল সারা  ইতে ।।
               সন ১২৫১ সালে    গোপিনাথ ক্রিপাবলে
                        মন্দির করিল মেরামতি
               হিসাব করহ সবে    ইহাতে নিকাস পাবে
                        কোবিতা সমাপ্ত হৈল ইতি ।। ৯
   লক্ষ করলে দেখা যাবে একটিও ‘শ’এর ব্যবহার নেই । সবই  ‘ স’। য়, য়া এর পরিবর্তে অ আ এর ব্যবহার। কৃ এর পরিবর্তে  ক্রি এর প্রয়োগ । ইতিহাসের জমিদার  শোভা সিংহের ঠিকাদার শ্যাম দাসের সামান্য অপরাধে মুণ্ডচ্ছেদ  করার আদেশ দিয়েছেন।  প্রজাদের সম্পদ অনেক সময় নবাবের  সৈন্য লুঠ করে নিত । সেই ভয়ে  শ্যাম দাস তাঁর  বসত বাড়ির চারদিকে গড় খাই কাটিয়ে ছিলেন। শ্যাম দাসের কাটা মুণ্ড দুর্গা দুর্গা বলেছিল  এর থেকে অনুমান করা খুব একটা ভুল হবে না যে শোভা সিংহের ( মৃত্যু ১৬৯৬ খ্রিঃ ) সমকালে   সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে  দেবী দুর্গা রাধাকান্তপুরের মত প্রত্যন্ত গ্রামেও ইষ্ট দেবী হিসেবে   পূজিত হতেন। শোভা  সিংহের ইষ্ট দেবী বিশালাক্ষীর মত শ্যাম দাসও নিজ গড়ে দুর্গা পূজার প্রচলন করেন। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের চব্বিশ বছর বয়সে ঘাটাল অঞ্চলের বাংলা ভাষা ও লেখ্যরীতির  নজির  পোড়ামাটিতে বিধৃত আছে গোপীনাথের  মন্দিরে।
 সেকালে যৌথ পরিবারে ভাইয়ের সঙ্গে অন্যান্য  ভাইদের কেমন সম্পর্ক ছিল, বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কেমন ছিল তা জানতে রাধাকান্তপুরের অন্য একটি মন্দির ঘোষ পাড়ার কাছে   দত্তদের কাশীশ্বর শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ফলক পড়ে নেওয়া যেতে পারে। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি গবেষক ক্ষেত্রসমীক্ষক তারাপদ সাঁতরা দেখতে এসেছিলেন । চুনসুরকির প্রলেপ দেয়া  মন্দিরটিতে তখনও  লিপিটি ছিল।  পরে সংস্কারের সময় লিপিটি  নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।  তারাপদ সাঁতরা লিপিটিকে অমরত্ব দিয়েছেন। তাঁর উদ্ধার করা লিপিটি হল-
      “ঁ ৭ শ্রী শ্রী কাসীস্বর মহাদেব স্থাপীত
      সকাব্দ ১৭৭৬
সন ১২৫২ সাল মাহ আসাড়
জেই হেতু মহাদেব কাশীশ্বর নাম
  কমললোচন দত্ত গীয়াছিল গয়াধাম
পিতার কর্ম্মপরে কাশী গমন বাসনা
কিন্তু গ্রিহে ভাত্রিগণ করিল মানা
প্রীত্যগমনেতে সিব স্থাপন করিবে
                         কাশীগমনের ফল তাহাতে পাইবে
এই হেতু  প্রকাশ হইল কাশীশ্বর
মন্দার সমান কাম মোদক কিংকর”
 মন্দিরে উৎকীর্ণ পদ্য কমললোচন নিজে লিখেছেন না অন্য কেউ এই পদ্য   লিখেছে তা আজ জানার  উপায় নেই।   তা যেই লিখে থাকুন না কেন,  এই পদ্যের সামাজিক মূল্য অপরিসীম । তৎকালে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে  পদব্রজে কষ্টকর গয়া  তীর্থ যাত্রা করত  মানুষ। এখনকার মতো গয়া ভ্রমণ ছিল না ।  পিতার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল হলে তবে মানুষ গয়াতে পিতৃকৃত্য করতে যেত। যৌথ পরিবারে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বেশ দৃঢ় ছিল। সংবাদ আদান প্রদান এবং ভায়েদের মতকে গুরুত্ব দেওয়া থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বাড়লে ভোগের বস্তুতে ব্যয় না করে দেব মন্দির তৈরি করত।  মিস্ত্রী কিংকর মোদকের মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায় এই লিপি থেকে । মন্দির নির্মাণ করতে গিয়ে দত্ত পরিবার  আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হলেও কাজে কোন গাফিলতি করেননি কিংকর মোদক।
       তৎকালে গ্রামে গঞ্জে হাঘরি তথা বেদের দল ঘুরে বেড়াত তারা বাঁশবাজি , হাত সাফাই  , বিভিন্ন  শারীরিক কসরত দেখাতো মেয়েরা ।  আজুড়িয়ার চরণদের মন্দিরে একেবারে উপরের দুটি কোণে এই রকম  মাথায় পা রেখে শারীরিক কসরত দেখানো দুই মহিলা ও শ্রীধরপুরে রঘুনাথের মন্দিরের দরজায় এক মহিলার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
 সুরতপুরে শীতলা মন্দিরে,  হরিরামপুরে শীতলানন্দ শিব  মন্দিরে  দেওয়ালে পর পর চামর হাতে দাসী।  দেবদাসী কিনা  জনিনা । হলে আমাদের দাসপুরেও  সমাজের এক কালো অধ্যায় দেবদাসী ছিল।
      দাসপুরের টেরেকোটা শোভিত মন্দিরগুলি আমাদের  অহংকারের, গর্বের, আত্মানুসন্ধানের ক্ষেত্র। আমাদের ইতিহাস,  সংস্কৃতিকে  জানার  উৎস।  সরকারি ঔদাসিন্য, উত্তরাধিকারীর রক্ষণাবেক্ষণের অক্ষমতা, আমজনতার  অবহেলায় মন্দিরগুলি ধ্বংসের মুখে  দাঁড়িয়ে আছে । অনেক মন্দির ইতিপূর্বে মাটির সঙ্গে  মিশে  গিয়েছে। অজ্ঞতা বশে টেরেকোটার ফলকগুলিতে সিমেন্টের প্রলেপ কোথাও বা রঙের প্রলেপ দিয়ে রক্ষা করতে গিয়ে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অমূল্য সম্পদকে ।
         পূর্বেই বলা হয়েছে দাসপুরের এই মন্দিরগুলির নির্মাতা আধিকাংশই জমিদার ,ব্যবসায় সূত্রে ধনী অথবা রাজকর্মচারী । দাসপুরের মন্দির টেরাকোটা ফলকের উল্লেখ যোগ্য বৈশিষ্ট্য হল , কৃষি প্রধান এলাকা হলেও  কেবলমাত্র দাসপুরের পালেদের  মন্দিরে বিষ্ণুর দশ অবতারের এক অবতার বলরামকে বোঝাতে বলরামের কাঁধে লাঙল  আছে। আর কোথাও কৃষক বা কৃষি কাজ সংক্রান্ত একটি  ফলক নেই। জমির আয়েই জমিদারদের খাদ্য বিলাস  ব্যসন আমোদ প্রমোদ পুজো অর্চনা সব চলত । কিন্তু জমির উপর নির্ভর করে জীবিকা অর্জন করা মানুষের কোন মর্যাদা ছিল না এদের কাছে । তার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যাবে মন্দির গাত্র অলংকরণে ।
         অথচ মন্দির নির্মাণের সময়েই দেবালয়  প্রতিষ্ঠাতাগণ দেবসেবার কাজ চালাতে এবং মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ করতে উত্তরাধিকারীদের যাতে কোন সমস্যায় পড়তে না হয় তার জন্য দেবদেবীর নামে প্রচুর ভূসম্পত্তি করে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ হয়ে যায়। জমিদারদের আয় তলানিতে এসে ঠেকে ।  মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা যায় কমে ।   জমি রাখার ঊর্ধব সীমা বেঁধে দেওয়ার ফলে বহু দেবোত্তর সম্পত্তি সরকার অধিগ্রহণ করে এবং  নাম মাত্র ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে সেই জমি সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়। এর ফলে উত্তরাধিকারীরা চরম বিপদে পড়ে ।আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়া জমিদার ও  বড় ব্যবসাদার নিজেদের  আভিজাত্যের অহংকারে সাধারণের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে সংকোচ বোধ করেছেন ফলে তাঁদের অধিকাংশের মন্দিরে কলি ফেরানর ক্ষমতাও চলে যায় । এক সময়ে  দাসপুরের মূল আয় হত রেশম আর কাঁসা পিতলের বাসন রপ্তানি করে। কৃত্রিম তন্তু আবিষ্কার , বয়ন শিল্পের যন্ত্রায়ণে প্রভূত উন্নতি, কাঁসা পিতলের চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে  আয় কম হওয়া, যোগ্য উত্তরসূরি না থাকা  প্রভৃতি কারণে  মন্দিরগুলি অবহেলিত হতে থাকে। শাসক ইংরেজ কৌশলে বোঝাতে পেরেছিল আমাদের যা কিছু আছে তা ইউরোপের তুলনায়  নিকৃষ্ট , তাদের আত্মকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা,  উদ্দেশ্যমূলক বিজ্ঞান শিক্ষা  মানুষকে নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিমুখ করে তুলেছিল। স্বাধীনতার পরে এখনো আমাদের অনেকের এ ঘোর কাটেনি।  স্বাধীনতার পর এক সময় আমারা স্পষ্ট বুঝে গেলাম ধর্ম মানে আফিম এমন কী মন্দিরে থাকা ভাস্কর্য গুলোও আফিম। এসব সংরক্ষণ অপেক্ষা বিদেশি ঠাকুরের মুর্তি স্থাপন অনেক বেশি মহিমাময় । ফলে আমাদের পূর্ব পুরুষের পোড়ামাটির ভাস্কর্য শোভিত অক্ষয় কীর্তির  এই মন্দির সমূহ অবহেলিত হতে থাকে। ।    আমাদের ভাবতে হবে, এইসব মন্দির কেবলমাত্র আর দেবদেবীর  মন্দির নয়, আমাদের ইতিহাস। সকলের সমবেত চেষ্টায় এগুলোর সংরক্ষণ হোক।  অতি সম্প্রতি মাদপুরের কাছে চমকার  এককালের নাগ বংশের জমিদার অযোধ্যারাম নাগের প্রতিষ্ঠিত দাসপুরের বিখ্যাত মন্দির স্থপতি ঠাকুরদাস শীল নির্মিত  শ্রীধরজিউর পরিত্যক্ত  নবরত্ন মন্দিরটি অরিন্দম ভৌমিক  ,  চিন্ময় দাশ , কমল ব্যানার্জী ও নাগ পরিবারের সদস্যগণের সমবেত প্রচেষ্টায় পরিষ্কার করে পুনরায় মন্দিরে দেব আরাধনা শুরু করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।  আমরাও দাসপুরের মন্দিরগুলি সম্পর্কে এই রকম ভাবলে  আমাদের পুর্ব পুরুষের অক্ষয় কীর্তি সমূহ রক্ষা পেতে পারে ।  দেশ থেকে বিদেশ থেকে  পর্যটকরা আসুন। দাসপুরের মন্দিরগুলি দেখুন।পর্যটন কেন্দ্র হোক  দাসপুর। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে কম উন্নত ছিলেন না ,তা দেখুক জগজনে।  দাসপুরবাসী হিসেবে আমরা গর্বিত হই।
গ্রন্থ ঋণ:
        পোড়ামাটির ভাস্কর্যে  সমাজ  আলেখ্য     তারাপদ সাঁতরা ।
            মন্দির ভাস্কর্যে প্রতিফলিত সমাজচিত্র     অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায।
        সূত্রধর শিল্প দাসপুর  ডঃ ত্রিপুরা বসু
        রচনা সংগ্রহ  তৃতীয় খণ্ড তারাপদ সাঁতরা
         মেদিনীপুর জেলার প্রত্নসম্পদ    প্রণব  রায়।
         ঘাটালের  কথা   পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও প্রণব  রায়।
         তারা মণ্ডল রূপিনী ।পালযুগের  ভাস্কর্যে     সৌরভ  রায়।
ব্যক্তিগত ঋণ :       সুকান্ত  সিংহ                 সয়লা
                   দেবাশিস কুইল্যা       পাঁচবেড়িয়া
                          মণিকান্ত  বেরা     সোনাখালি।
              মহাদেব চক্রবর্তী    লাউখানা
নিউজ ডেস্ক: ‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: ss.ghatal@gmail.com •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।