প্রশাসন চাইলে অনেক কিছুই পারে:দাসপুরে ‘গুণধর’ সন্তানের কাছ থেকে মায়ের সম্পত্তি ফেরানোর ঘটনা তারই বিরল দৃষ্টান্ত

দেবাশিস কর্মকার: সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি লিখিয়ে নেওয়ার পর বৃদ্ধা মায়ের ন্যূনতম দেখভাল করেনি ছেলে। দাসপুরের অশীতিপর বৃদ্ধা করুণা কালসার ঘাটাল মহকুমা প্রশাসনের শরণাপন্ন হন। ট্রাইব্যুনাল ফর মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্স আইন (২০০৭) অনুযায়ী দানপত্র দলিল বাতিল করা হয়। ওই আইনটি ২০০৭সাল থেকে থাকলেও তার প্রয়োগ সেভাবে হয়নি। প্রত্যেক মহকুমার মহকুমা শাসক ওই ট্রাইবুনালের প্রিজাইটিং অফিসার। ঘাটালের মহকুমা শাসক অসীম পাল বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এই নজির বিহীন কাজটি করলেন। আইন প্রয়োগ করেই আগস্ট মাসে বৃদ্ধার দানপত্র করা দলিল বাতিল করা হয়েছে এবং ১০ সেপ্টেম্বর বৃদ্ধার হাতে সমস্ত সম্পত্তির নতুন নথি তুলে দেওয়া হয়েছে। এক সময়ে প্রলোভন দেখিয়ে ছেলের লিখিয়ে নেওয়া সমস্ত সম্পতির মালিক এখন ওই বৃদ্ধা।[•এই খবর সম্পর্কিত ভিডিওটি দেখতে চাইলে ▶এখানে ক্লিক করতে পারেন।]
মহকুমা শাসক আইনকে প্রয়োগ করে যা করলেন তা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন মহকুমার বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা। কারণ অনেক মা ও বাবাই এই ধরনের ঘটনার প্রচ্ছন্ন শিকার হচ্ছেন। ‘প্রতিকার নেই’ ভেবেই তাঁরা সহ্য করে চলেছেন। অন্য দিকে ওই ধরনের ‘গুণধর’ সন্তানেরাও সাম্প্রতিক এই রায় দেখে বেশ আতঙ্কিত।
সম্পূর্ণ বিষয়টির নিষ্পত্তিতে প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গে মানবিকতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন মহকুমাশাসক অসীম পাল। ঘাটাল মহকুমার ট্রাইব্যুনাল ফর মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্সের প্রিজাইডিং অফিসার হিসাবে বিষয়টির প্রতি প্রথম থেকেই প্রশাসনের একটি দৃঢ় অবস্থান নির্দিষ্ট করেন। সেইসঙ্গে নিজ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় আইন ঘেঁটে, বিশেষজ্ঞদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে একটি সুষ্ঠু সমাধান বের করেন তিনি। পাশাপাশি তা কার্যকর করতেও অতিরিক্ত সময় ব্যয় করেননি।
অন্যদিকে শারীরিক অসুস্থতার দরুন সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় করুণাদেবীকে। জমি ফেরতের যাবতীয় দলিলের নথি তখন প্রায় তৈরির পথে। এই পরিস্থিতিতে করুণাদেবীর শারীরিক অবনতি দেখে রাতের ঘুম উড়ে যায় তাঁর। শেষ পর্যন্ত স্থির থাকতে না পেরে, তিনি নিজে থেকেই হাসপাতালের সুপারকে ফোনে করুণাদেবীর বিশেষ যত্ন নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ঘাটাল ব্লকের আলুই হাইস্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা শম্পা পাল বলেন, এক জন আধিকারিক মনের ভেতর থেকে এই কাজটি না করলে তাঁর এভাবে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা নয়। মহকুমা শাসক তো বললেই পারতেন, তাঁর যা করার তিনি তা করে দিয়েছেন। বৃদ্ধা জীবিত অবস্থায় তা হাতে পেলেন কি পেলেন না তা নিয়ে মাথা ব্যথা করতেন না। শুধু তাই নয়, ১০ সেপ্টেম্বর মহকুমা শাসকের অফিসে সম্পত্তির নথি করুণাদেবীর হাতে তুলে দেওয়ার সময় বৃদ্ধাকে ফুলের মালা দিয়ে সম্মানও জানান মহকুমা শাসক। মহকুমা শাসক চিকিৎসার জন্য কয়েক হাজার টাকাও তুলে দেন বৃদ্ধার হাতে।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে ট্রাইব্যুনাল ফর মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্স আইনটি কার্যকরী হওয়ার পর ঘাটালে এই প্রথম আইনটি প্রয়োগ করে কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হল। রাজ্যেও এই আইনের প্রয়োগ কতগুলি হয়েছে তা হয়তো হাতে গোনা যাবে। কিন্তু এমন অমানবিক ঘটনার নজির ঘাটালে এই প্রথমবার নয়। এর আগেও এমন বহু অভিযোগ জমা পড়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরে। কিন্তু এই নিয়ে কোনও কাজ এগোয়নি বলে জানা গিয়েছে। বার বার মহকুমা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা হতাশ হয়ে সন্তানদের অত্যাচারই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ নানা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজের মধ্যে ওই অভিযোগ পত্রগুলি ফাইলবন্দি হয়েই পড়ে রয়ে যেত। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ঘাটাল মহকুমার ট্রাইব্যুনাল ফর মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেন্সের প্রিজাইডিং অফিসের দফতরটিই কার্যত অজানা ছিল ঘাটালবাসীর কাছে। কারণ, এই সমস্যাগুলির সমাধানে প্রশাসন সেই অর্থে এগিয়ে আসেনি এর আগে। কিন্তু ঘাটালের বর্তমান মহকুমা শাসক অসীম পাল দায়িত্ব গ্রহণের পরই ঘাটালবাসী তাঁর মধ্যে একটি অন্য ঘরানার প্রশাসন পরিচালনার নিদর্শন লক্ষ্য করেছেন। ইতিমধ্যেই মানবদরদী প্রশাসক হিসাবে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। চেয়ারের বাইরেও মানবিকভাবে অনেক কাজ করেছেন যা মহকুমা শাসক হিসেবে তিনি করতে বাধ্য নন। দাসপুরের ওই বৃদ্ধার সম্পত্তি ফিরিয়ে দিয়ে আরও একটি অনন্য নজির গড়লেন মহকুমা শাসক।
অন্যদিকে, বৃদ্ধাকে সম্পত্তি ফেরতের বিষয়টি জনসমক্ষে এলে একটি ইতিবাচক সামাজিক বাতাবরণ তৈরি করবে বলে অনেকে মনে করছেন। কারণ, এই ঘটনাটির মধ্যে দিয়ে সরকারি তরফে সমাজের কাছে বার্তা গিয়েছে যে এই জাতীয় যেকোনও দুষ্কর্মকে কড়া হাতে দমন করবে প্রশাসন। প্রয়োজনে এর জন্য সংশ্লিষ্ট আইনের সাহায্য নেওয়া হবে। তাই পুরো বিষয়টিতে বিশেষ করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অনেকবেশি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। তাঁরা জানালেন, যেকোনও দুঃসময়ে তাঁদের পাশে আর কেউ না থাক প্রশাসন তাঁদের পাশে আছে।
ঘাটাল মহকুমার সমস্ত খবর পেতে আমাদের MyGhatal মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করুন [লিঙ্ক 👆] এবং ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখুন[লিঙ্ক 👆]

দেবাশিস কর্মকার: ঘাটাল মহকুমার যে কোনও খবর/সমস্যার কথা আমাকে জানাতে পারেন। মো: 9002782999 / 9732738015 /9933066200 •ইমেল: dk.ghatal@gmail.com