নির্বাচন আর বন্যা হলেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি আর স্তোকবাক্য

মনসারাম কর, স্থানীয় সংবাদ, ঘাটাল:  ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে সত্তরের দশক থেকে দুই সরকারের হেবি ওয়েট নেতা মন্ত্রী বা সরকারি আমলারা যাই বলুক বা করুক না কেন এটা ঠিক যে বন্যার দুর্ভোগ থেকে আজও রেহাই পায়নি ঘাটালবাসী। ফি বছর বন্যার সময় জল যন্ত্রণা, দুশ্চিন্তা, বাড়ির ছাদে ত্রিপল মাথায় নিয়ে রাত কাটানো, কাঁচা বাড়ির মায়া ত্যাগ করে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া, ডিঙ্গি, নৌকা আর কলাভেলায় জল পার হওয়া আর ত্রাণের জন্য শাসক দলের নেতা নেতৃত্বদের কাছে অনুনয় বিনয় করা, এটাই ঘাটালবাসীর বাস্তব চিত্র থেকে গেছে আজও। তাই প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে

রাজনৈতিক দলের মঞ্চ কাঁপানো ঝড় তোলা বক্তব্য আর বন্যার সময় অসহায় ঘাটালবাসীর কাছে এসে কিছু সহানুভূতি দেখানো ছাড়া তেমন কিছুই করেনি বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ঘাটালবাসীর একাংশের। সত্তরের দশক থেকে ২০১০ পর্যন্ত মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কার্যত শীতঘুমে কাটিয়েছে তৎকালীন বাম সরকার। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার আগে থেকে ২০১৫ পর্যন্ত একের পর এক নির্বাচন আর বন্যার সময় মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ নিয়ে কেবল মাত্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তৃণমূল সরকারের নেতা, মন্ত্রী,সাংসদ বিধায়করা। ২০১৫ সালের পর থেকে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি এবং রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের মধ্যে কেবলই চলছে রাজনৈতিক তরজা আর দশকের পর দশক বন্যার

তিমিরেই থেকে গেছে ঘাটাল।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নারায়ণ নায়েক সম্প্রতি বলেন, দুই সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান এতদিন অধরা থাকত না। আসলে মানুষের দুর্ভোগের কথা কেউ ভাবেন না, কেন্দ্র অর্থ বরাদ্দ না করলে সেখানে রাজ্য সরকার শুধু অভিযোগ তুলে বসে থাকতে পারে না, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে রাজ্যকে। ১৯৮২ সালের বাম আমলে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের শিলান্যাসের পর ১৯৮৯ পর্যন্ত কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার রাজ্যে বাম সরকার, তবুও মাষ্টার প্ল্যান হয়নি। ১৯৮৯-১৯৯০ কেন্দ্রে জনতা সরকার রাজ্যে বাম সরকার, মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ হয়নি। ১৯৯১-১৯৯৬ কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার রাজ্যে বাম সরকার (১৫ দিনের জন্য বিজেপি সরকার), মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ হয়নি। ১৯৯৬-১৯৯৮ কেন্দ্রে সমাজবাদী জনতাদল রাজ্যে বাম সরকার, মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ হয়নি। ১৯৯৮-২০০৪ কেন্দ্রে বিজেপি রাজ্যে বাম সরকার, মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ হয়নি। ২০০৪-২০১১ কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেস রাজ্যে বাম সরকার, মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ হয়নি। ২০১১-২০১৪ কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেস রাজ্যে তৃণমূল সরকার। এক বছর এরাজ্যে কংগ্রেসের সাথে তৃণমূলের জোট সরকার থাকলেও মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ হয়নি। ২০১৪-২০২১ কেন্দ্রে বিজেপি রাজ্যে তৃণমূল সরকার, মাস্টার প্ল্যান আজও হয়নি।
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার আগে ঘাটালের নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূলের ছোট বড় সব তৃণমূল নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি ছিল ক্ষমতায় এলে ঘাটালবাসীর বন্যা যন্ত্রণা দূর করতে প্রথমেই মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ করা হবে। ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও ঘাটালে একাধিক বার বলে গেছেন কেন্দ্রের কাছে আন্দোলন করে হলেও ঘাটালবাসীর জন্য মাস্টার প্ল্যান কার্যকর করা হবে।
গত ২৬ মার্চ বিধানসভা ভোটে নির্বাচনী প্রচারে ঘাটালের দাসপুর এবং পরে চন্দ্রকোণা থেকে মাস্টার প্ল্যানের কথা শোনা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। সেদিনও তিনি বলে গিয়েছিলেন, কেন্দ্রের কাছ থেকে মাস্টার প্ল্যানের অর্থ অনুমোদন করিয়েই ছাড়বেন। কথা দিয়েছিলেন, যদি মোদীবাবুর সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের অর্থ অনুমোদন না করে তাহলে দিল্লিতে গিয়ে ধরনায় বসবেন।
৬ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মেদিনীপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে তিনি বলেন, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণে রাজ্য সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী। কেন্দ্র কোনও সাহায্য করেনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কেন্দ্র তো কিছুই দেয়নি। আমরাই ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাব। মাস্টার প্ল্যানের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন খাল-নদী সংস্কার রাজ্য সরকার করে দেবে। সেই মতো দাসপুর-১ এবং দাসপুর-২ ব্লকের কয়েকটি মজে যাওয়া খাল সংস্কার করা হলেও মূল এলাকায় কোনও কাজ করা হয়নি বলে অভিযোগ।
১০ আগষ্ট ২০২১ তারিখে ঘাটালে বন্যা পরিদর্শনে এসে মুখ্যমন্ত্রী ফের বলেন, ঝাড়গ্রাম থেকে আসার পথে হেলিকপ্টার থেকে দেখেছি বাড়ি, ঘর, মাঠ দোকান সব ভেসে গিয়েছে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে বার বার বলা হচ্ছে। কেন্দ্র অনুমোদন দিচ্ছে না। ছোটবেলা থেকে মানসদাদের(মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া) কাছে শুনছি মেদিনীপুর মানেই কপালেশ্বর-কেলেঘাই প্রকল্প। আমরা ৭০০ কোটি টাকা দিয়ে সেই কাজ করে দিয়েছি। ফলে মানুষ অনেকটাই উপকৃত হয়েছেন। এখন বর্ষা বেশি হচ্ছে। তার উপর জল ছেড়ে দেওয়ার ফলে পরিকল্পিত বন্যা হচ্ছে প্রতি বছর। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, নিম্ন দামোদর অববাহিকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ২৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্য সরকার। চেক ড্যাম তৈরি করতে দেওয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে অনুমোদন না দেওয়াতেই ঘাটালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ঘাটালের অবস্থা ভয়াবহ। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কার্যকর না হলে ঘাটালকে বাঁচানো যাবে না। আমরা যতটা করার করেছি। একই সাথে তিনি ঘাটালের সাংসদ দীপক অধিকারী(দেব)সহ দলের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিধায়ককে পার্লামেন্টে মাস্টার প্ল্যান নিয়ে সরব হতে বলেন।
ঘাটালবাসীর দাবি স্তোক বাক্য নয়, চাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ। মাস্টার প্ল্যান দশকের পর দশক ঠাণ্ডা ঘরেই আটকে থেকে গেছে। কবে কার্যকর হবে বা আদৌ আর হবে কিনা তা সংশয় প্রকাশ করছেন ঘাটালের মানুষ। আর তা যদি কার্যকর না হয় তাহলে রাজ্য সরকারকেই ছোট ছোট প্রকল্প করে শিলাবতী কংসাবতী সহ অন্য নদীগুলির সংস্কার ও ঘাটাল শহরের কয়েকটি জায়গায় পাম্প বসানোর পথে এখনই হাঁটতে হবে। রাজ্যকে বিঁধে ঘাটালের বিধায়ক শীতল কপাটের দাবি রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কাছে গিয়ে মাস্টার প্ল্যানের টাকা চান, কেন্দ্র না দিলে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেবেন তিনি। প্রসঙ্গত, বন্যার সময় কয়েক দশক আগে ঘাটালের যে ব্যক্তি তার সন্তানকে কোলে পিঠে করে জল পার হতে হতে বলতো মাস্টার প্ল্যান হলে বন্যা আর হবে না, সেই ব্যক্তি এখনও তার নাতি নাতনিদের একই কথা বলতে থাকেন কিন্তু মাস্টার প্ল্যান শুধু রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি আর স্তোক বাক্যই থেকে গেছে বাস্তবে নেই।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।