শ্লীলতাহানি: শিক্ষক, ছাত্রী ও আমাদের সমাজের ভাবনার দূরদর্শিতা

পাশের জেলার এক প্রধান শিক্ষককে শ্লীলতাহানির অভিযোগে ছাত্রীরাই বেঁধেজুতা পেটা করছে।

দেবাশিস কুইল্যা:পরাধুনিক সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নানান বিশৃঙ্খলার সহযোগী হিসেবে ‘শ্লীলতাহানি’ মানসিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কৌমার্য্য দূষণে মুখরোচক আলোচিত বিষয়, যা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঔদার্যতা কলুষিত করে গভীর বিশ্বাসে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্র শুধু বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তা বহুদূর বিস্তৃত। এদের কেন্দ্রে অবস্থান করে পরিচালক সমিতি ও অভিভাবক। যাদের সীমানায় আবর্তিত হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা; যাদের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্রের মাধ্যম শিক্ষা। যেখানে অর্জিত জ্ঞান শিক্ষার্থীর মন ও জীবনকে আলোকিত ক’রে সুন্দর করে, পরিমার্জিত ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। শিক্ষা হল; একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক, একজন অনুপ্রাণিত শিক্ষার্থী এবং উদ্যোগী অভিভাবকের মিলিত প্রতিশ্রুতির সমন্বয়। এই সমন্বয় সমাজকে সুন্দর করে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দানের মহান দায়িত্ব অর্পিত হয় শিক্ষকের ওপর। শিক্ষক শুধু প্রতিষ্ঠান বা পুঁথির ধারণার বাইরেও শিক্ষার্থীদের আদর্শবান করে তোলেন। সেখানে তিনি শুধু গুরু। পিতা, মাতা, বন্ধু অথবা অভিভাবক নন; তিনি শিক্ষার্থীদের মৌলিক চিন্তার, দায়িত্ববোধের জাগরুক।
ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের হোঁচট খেতে হয় বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে। যেখানে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে দুষ্ট সংবাদ শিরোনামে। প্রশ্ন জাগে এই অভিযোগের ভিত্তি ও তার সত্যতা সম্পর্কে আর কারণ উদ্ঘাটনে।
এই গভীর অসুখের মূলে আছে শিক্ষাক্ষেত্রে কৃত্রিমতা, ব্যক্তিস্বার্থ ও লাভ ক্ষতির হিসাব। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুসম্পর্ক, দায়িত্ব ও ন্যায়পরায়ণতা সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে যেকোনও ধরনের ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা এখন ইতিহাস। চাটুকারিতা, ক্যাডারবাজি ও লেজুড় বৃত্তির মানসিকতা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যা কিনা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে শিক্ষার জগতে এই ধরণের ঘটনা ঘটা বা ঘটানো অসম্ভব নয়। বর্তমানে একটা শব্দ বহুল আলোচিত ‘Open secret’ (প্রকাশিত গোপন কথা)। এই শব্দটি শিক্ষাক্ষেত্রে যেকোনও শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা শ্লীলতাহানি বা যৌন হয়রানির অভিযোগ বিশ্লেষণ করতে শেখায়। সমাজতত্ত্বের আলোচনায় লক্ষ্য করা গেছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অধিকাংশ সময়ে সংকীর্ণ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় রাজনৈতিক দলের প্রভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদী বা প্রকৃত শিক্ষার আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বোধহীন ছাত্রীর সাথে হীন সম্পর্কে জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় মোড়লের নির্দেশে অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তির অঙ্গুলিহেলনে। আবার উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় অনেক বুদ্ধিমান ছাত্রী নিজের জীবনে উজ্জ্বল নির্ভরতার জায়গা তৈরি করতে বা অপছন্দের শিক্ষকদের বা শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ভাবে বিকৃত অরুচিকর যৌন হয়রানি বা শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনতে কুন্ঠিত হয় না। অপরদিকে শিক্ষকেরাও এই দুষ্ট অভিযোগ থেকে মুক্ত এমনটাও নয়। যেমন একটি পুরুষের বা নারীর জৈবিক চাহিদা অস্বীকার করার উপায় নেই তেমনি অনেক শিক্ষক আছেন যারা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্য করেন সমস্ত নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে। ব্ল্যাকমেল হওয়া ছাত্রীটি তখনই অভিযোগ আনতে বাধ্য হয় যখন তার বিশেষ কিছু করার থাকে না বা হারানোর কিছু নাই। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার আঙিনায় এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন সমাজতাত্ত্বিকগণ।
আমাদের মূল্যবোধহীন রাজনৈতিক নির্ভরতা উভয়কেই প্রভাবিত করে ও করতে বাধ্য করে। একজন ব্যবহৃত হয় অপরদিকে অন্যজন হয় অভিযুক্ত। সে দুজনের (শিক্ষক ও ছাত্রী) যে কেউ হতে পারে। কারণ এখানেই শেষ নয়; বর্তমান শিক্ষার মাধ্যম বড় বেশি যান্ত্রিক ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ায় পরস্পরের মধ্যে বাড়ছে সুস্থ মানসিকতার দূরত্ব, পরস্পরকে বুঝতে না পারার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অকপটে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনতে দ্বিধা করে না। পরিবার ও সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় উভয়ের মধ্যে প্রভাব ফেলে। একজন শিক্ষক তার কর্তব্যজ্ঞান ও মূল্যবোধ ভুলে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ ও বাড়তি প্রতিপত্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করেন তখনই তিনি তার অজান্তেই প্রতিপক্ষ তৈরি করে ফেলেন এবং শিক্ষক তার আদর্শ ও নৈতিক অবস্থান ঠিক রাখতে না পারার কারণেই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ লঙ্ঘন করতে পারেন না। ফলে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টি তার উপর পড়ে। সাময়িকভাবে সমাজ ও দেশ হয় কলুষিত। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় অভিযুক্ত শিক্ষকের প্রতিপক্ষ সমাজের দণ্ডমুণ্ডের দল অর্থনৈতিক সুবিধা না পাওয়া ও কম লেখাপড়া জানা পরিবারের মেয়েটিকে অজান্তে ব্যবহার করেন।
তাই সুস্থ সমাজ ও সুস্থ সংস্কৃতির পরিপন্থী শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা শ্লীলতাহানি ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগের ভিত্তি যতটাই হোক তার বিশ্লেষণ ও শাস্তির ব্যবস্থা করা ও এই গভীর অসুখের প্রতিবিধান করতে পারে একমাত্র পরিচালক সমিতি ও অভিভাবক। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যেহেতু প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সেখানে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সমিতিই পারবেন এই কাজ করতে। সে বিদ্যালয় হোক বা বিশ্ববিদ্যালয়। আর পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উদ্যোগ। প্রতিবিধান, শাস্তির দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। এ দায় তাদের। কেন না দায়িত্ব পালন ক্ষমতার অধিকারী। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পরিচালক সমিতি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান উভয়ের (শিক্ষক ও অভিযোগকারী ছাত্রী) পুক্ষানুপুক্ষ বিশ্লেষণ করবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ও দায়িত্বশীল মূল্যবোধে বিশ্বাসী থেকে বিচার করবেন ও সিদ্ধান্ত এক্কেবারে দুইদিক সমান নিত্তিতে। কেননা তাদের উপরই প্রতিষ্ঠান ও সমাজের জন্য ভবিষ্যতের উদাহরণ অপেক্ষায় থাকবে। অন্যদিকে পরিবার পরিশীলিত ভাবনায় ওই প্রাতিষ্ঠানিক উদাহরণ কার্যকর করবে। ফলে এটা আশার আলো জাগাবে সমাজের বুকে বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে এমন অবাঞ্ছিত ঘটনার মূলোৎপাটনে। যা সমাজ ও দেশের কল্যাণ। •বাঁকুড়ার জেলার সিমলাপাল থানার অন্তর্গত উন্তীশোল রসনাময়ী সম্মিলনী জুনিয়ার হাই স্কুলের ছাত্রীরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অরুণকুমার সিংহ মহাপাত্রকে স্কুল প্রাঙ্গণের গাছে বেঁধে এভাবেই জুতোপেটা করছে। ছাত্রীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, দিনের-পর-দিন নানান অছিলায়প্রধান শিক্ষক ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করে আসছেন। ৬ মার্চ ২০২০’র ঘটনা।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।