অনন্য নজির: সময়ের সঙ্গে লড়াই করে সব্জি বিক্রেতা থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক

তৃপ্তি পাল কর্মকার: অর্থাভাবে একদিন যে বালকটিকে নিজের স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে হয়েছিল তিনিই বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে সেই স্কুলের এক ভবন করে দিলেন। শুধুমাত্র আত্মপ্রত্যয়ের ওপর ভর করে যে জীবনে অনেক কিছুই করা যায় তা আরও একবার প্রমাণ করে দিলেন বাগবেড়ের পতিতপাবন চৌধুরী। শুধু পতিতপাবন চৌধুরী নন, ডাঃ পতিতপাবন চৌধুরী।


ডাঃ চৌধুরী বর্তমানে কলকাতার বাগুইহাটির সুপ্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। কিন্তু তাঁর জন্ম দাসপুর ২ ব্লকের কামালপুর- বাগবেড়ে।
অত্যন্ত দরিদ্র কৃষকের পরিবারে ১৯৫১ সালে (২৩শে আগষ্ট) তাঁর জন্ম। ওই পরিবারে দুবেলা পেট ভরে খাবার পাওয়াটাই যেখানে বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ত, সেই পরিবারের ছেলের কাছে পড়াশোনা ‘সোনার পাথর বাটির’ মতো গল্প।
পরিবারের ওই দুরবস্থার মাধ্যমেই বাবা হরেকৃষ্ণ চৌহান এবং মা গৌরী চৌহান (পরে পতিতবাবুদের পদবি বদলে চৌধুরী হয়েছে) তাঁকে বা­ড়ির সামনের প্রাথমিক স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করেন। দারিদ্রতা তাঁর মেধাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। দুবেলা ভাল করে খেতে না পেলেও ওই ছাত্র ১৯৬০ সালের বৃত্তি পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য পান। ১৯৬১ সালে বাবা রানিচক দেশপ্রাণ হাইস্কুলে ভর্তি করলেন ছেলেকে। কোনও রকমে দুবছর পড়ার পর আর্থিক অনটনের কারণে সপ্তম শ্রেণীতে উঠে পড়া ছেড়ে দিতে হল পতিতবাবুকে। পতিতবাবুর পরিবারে বাবা-মা, ভাই-বোন করে পরিবারে সদস্য সংখ্যা অনেক। বাবার পক্ষে অনটন মাথায় করে এতগুলো মানুষের সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। চাষবাসের কাজে লাগতে হবে। তাই চোখের জল চোখের কোণে মুছেই পতিতবাবুকে পড়াশোনা ছাড়তেই হল।
চাষের ফসল বিক্রি করতে যেতে হত রাজহাটি, ঘাটাল বাজার, দাসপুর বাজারে। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রাতে দুচোখ জুড়িয়ে নেমে আসত ঘুম। সেই ঘুমের মধ্যে অধরা স্বপ্নগুলো ছুঁয়ে যেত পতিতবাবুকে। চোখ জুড়ানো সেই স্বপ্ন ছিল পাঁচজনের একজন হবার স্বপ্ন। ভোরে ঘুম ভাঙলে মরীচিকার মতো উবে যেত স্বপ্নের রেশ। তবুও গোপনে মনের গভীরে স্বপ্নকে লালন পালন করতে থাকে অবোধ কিশোর।
ইতিমধ্যে চাষবাসের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে তিন তিনটি বছর। তারপর যেন হঠাৎ করেই দেবদূতের আগমণ হল। সেই সময় রানীচক দেশপ্রাণ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিওরবেড়িয়া গ্রামের অচ্যুতনাথ মাইতি। একদিন হঠাৎ স্কুল ছুটির পর হরেকৃষ্ণবাবুর সাথে দেখা করতে এলেন। অনুরোধ করলেন পতিতবাবুকে আবার স্কুলে নিয়ে যেতে চান তিনি। যাবতীয় পড়াশোনার খরচাপাতির ব্যবস্থা তিনি করবেন বলে কথা দিলেন।
তখনকার দিনে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল সমাজ। প্রধান শিক্ষক বাড়িতে এসে অনুরোধ করেছেন, তাই নিমরাজি হলেও হরেকৃষ্ণবাবু আবার ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে রাজি হলেন।
১৯৬৬ সালে রানীচক দেশপ্রাণ হাইস্কুলে আবার সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হলেন পতিতবাবু।
পড়াশোনায় তিন তিনটে বছর পূর্ণচ্ছেদ পড়ে গিয়েছিল। তাই স্কুলের পরেও বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক, করণিক সবাই পতিতবাবুকে পড়াশোনায় সাহায্য করতে লাগলেন। প্রতি বছর ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় হতে থাকেন তিনি।
১৯৭১ সালে উচ্চমাধ্যমিকে তাক লাগানো রেজাল্ট হল পতিতবাবুর।
যোগাযোগ ব্যবস্থা সে অর্থে ভালো ছিল না তখন। গ্রাম ছিল বহু পিছিয়ে। তাই কোথায় কোন কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে পতিতবাবু জানতেই পারেননি। সমস্ত কলেজেই ভর্তির সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। এদিকে কলকাতা যাবার রাস্তাভাড়াটুকুও নেই। অনেক কষ্টে এর-ওর কাছ থেকে রাস্তা ভাড়া চেয়ে কলকাতার পথে যাত্রা। একমাত্র প্রেসিডেন্সিতে মেধার ভিত্তিতে ভর্তি চলছে তখন। ভালো নাম্বার ছিল বলে কেমিস্ট্রি অনার্সে ভর্তি হলেন তিনি।
এর মধ্যেই মেধার ভিত্তিতে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। কিন্তু বিধি বাম। দরিদ্র পিতার সামর্থ্য নেই সন্তানকে ডাক্তারি পড়ানোর। তবে কী আবার বন্ধ হবে এতোখানি সুযোগ? সে সময় পাশে দাঁড়ালেন রানীচকের প্রভাস সামন্ত, প্রফুল্ল সামন্ত, তারকনাথ সাঁতরা। পতিতবাবুকে সাহস যোগালেন। বললেন, তুই ভর্তি হয়ে যা, খরচাপাতি আমরা যোগাবো। সে সময় মাসে ৩০ টাকার ব্যবস্থা প্রভাসবাবুরা সকলে মিলে করে দিয়েছিলেন। রাতে থাকার ব্যবস্থা ছিল না। যুগান্তর পত্রিকার অফিসের সামনে রাস্তায় ঘুমোতে হত। আর স্ট্রিট লাইটের আলোয় চলত ডাক্তারির পড়াশোনা। পাশ করলেন এমবিবিএস।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!