‘চাঁচর উৎসবের কথা’ —অরূপরতন মিশ্র

‘চাঁচর উৎসবের কথা’ —অরূপরতন মিশ্র
সূচনাঃ সনাতন শাস্ত্রে চাঁচর বা হোলিকাদহন উৎসবের মূল তাৎপর্য হল–অশুভের বিনাশ [‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]এবং শুভের জয়— অন্যায়, অসত্য, জড়তা, অজ্ঞতার অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে আলোর ভোরের আবাহন। অন্ধকারের সঙ্গে আলোর লড়াই কি সমাজজীবনে, কি ব্যক্তিজীবনে, কি প্রকৃতি জগতে চিরকাল ধরে চলেছে। সত্যপথে ঐক্যবদ্ধভবে এই সংগ্রামে ব্রতী হয়ে নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে রক্ষা করাএবং সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উন্নতচেতা মানুষের পবিত্র উদ্দেশ্য । চাঁচর সেই ধারাবাহিক সংগ্রাম ও সাফল্যের স্মরণ-মনন ও অঙ্গীকারের

উৎসব।
চাঁচরের পুরাকথাঃ চাঁচর হল হোলিকা দহনের বঙ্গীয় রূপ। বাংলায় এই উৎসবটি দোলপূর্ণিমার পূর্ববর্তী সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন পুরাণে এই হোলিকা দহনের কাহিনী আছে। তবে স্কন্দপুরাণের কাহিনীটি বেশি প্রচলিত।
হোলিকাদহন হলো হোলিকা -ভক্ত প্রহ্লাদের উপাখ্যান। প্রহ্লাদের পিতা হিরণ্যকশিপু অত্যাচারী অসুর রাজা ছিলেন। তাঁর দাদা হিরণ্যাক্ষকে বিষ্ণু বধ করেছিলেন বলে বিষ্ণুর ওপর তিনি প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ ছিলেন। তিনি অমরত্বের জন্য কঠোর তপস্যা করে বরও পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মার সেই বরে অনেক ফাঁক ফোকর ছিলো ।তবু তাতেই খুশি হয়ে হিরন্যকশিপু নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেন। সকলকে বাধ্য

করেন, তাঁকে পূজা করার জন্য। কিন্তু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ বিষ্ণুভক্ত। কোনমতেই তার পিতাকে ঈশ্বর মানতে রাজি নয়। অবাধ্য পুত্রকে হত্যা করার জন্য হাতির পায়ে পিষে,বিষধর সাপ দংশন করিয়েও ব্যর্থ হন হিরণ্যকশিপু। বিষ্ণুর আশীর্বাদে বারবার বেঁচে যায় প্রহ্লাদ। তখন তাঁর বোন হোলিকা রাক্ষসীকে হিরণ্যকশিপু দায়িত্ব দেন। হোলিকা বর পেয়েছিলো, আগুনে পুড়ে তার মৃত্যু হবে না। তাই সে ভাইপো প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করেছিলো; ভেবে ছিলো, প্রহ্লাদ পুড়ে মরলেও তার কিছু হবে না। কিন্তু তার প্রাপ্ত বরেও ফাঁক ছিলো, আগুন দিয়ে অন্যের ক্ষতি করতে চাইলে এ বর কাজে লাগবে না। বিষ্ণুও তাঁর একান্ত ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করলেন। ফলতঃ হোলিকা রাক্ষসী পুড়ে মারা গেল। অশুভ শক্তির বিনাশ হলো। ভগবান সত্যের পথে থাকা ভক্তের রক্ষাকর্তা এবং দুষ্টের দমনকারী।
এই হোলিকাদহন বাংলার চাঁচর উৎসবেও প্রতিফলিত। এই চাঁচরকে নানা জায়গায় নানা নামে ডাকা হয়—বুড়ির ঘর পোড়ানো, ন্যাড়া পোড়া, মেড়া পোড়া ইত্যাদি।
চাঁচরে অগ্নিসংযোগের বিধিঃ
‌শুকনো ঝরাপাতা দিয়ে স্তম্ভ বা গৃহ নির্মান করা হয়। সায়ংকালে সেখানে ফুলপত্রাদি দিয়ে পুজো করে অগ্নিসংযোগ । বিনামন্ত্রে অগ্নিসংযোগ না করে জ্যোতিরগ্নিঃ অগ্নির্জ্যোতিঃ পাঠ করে শলাকা দিয়ে অগ্নি দিলে ভালো হয়। এরপর অগ্নির স্তব করতে পারেনঃ
ওঁ সহস্রাক্ষো বিচর্ষনিরগ্নি রক্ষাংসি সেধতি।
হোতা গৃণীত উক্থ্য।। (ঋকবেদ/১ম মণ্ডল/৭৯ সূক্ত/১২ মন্ত্র)
অর্থঃ সহস্রাক্ষ সর্বদর্শী অগ্নিদেব রাক্ষসদের তাড়িত করেন। স্তুত অগ্নিদেব আমাদের পক্ষে সকল দেবতার নিকট স্তুতি পৌঁছে দেন।
ওঁ ত্বেষাসো অগ্নেরমবস্তো অর্চয়ো ভীমাসো ন প্রতীতয়ে।
রক্ষস্বিনঃ সদমিদ্যাতুহমাবতো বিশ্বং সমত্রিণং দহ।।
ঋকবেদ(১ম/৩৬সূ/২০ম)
অর্থঃ
হে অগ্নিদেব! তোমার শিখা অভাবনীয় প্রদীপ্ত, শক্তিমান ও ভীষণ।
তুমি বিশ্বগ্রাসী অশুভ রাক্ষসদের দহন কর।
প্রণামঃ স নঃ পিতেব সূনবেহগ্নে সুপায়নো ভব।
সচস্বা নঃ স্বস্তয়ে।।
ভাবার্থ–পিতার মতো তুমি আমাদের মঙ্গলকারী হও।
চাঁচর প্রজ্জ্বলনকালে গীতবাদ্য সহকারে ইষ্টদেবতাকে নিয়ে স্থলটি প্রদক্ষিণ করা হয়।
রাক্ষস বলতে অন্য কিছু নয়, আর্যও নয়, অনার্যও নয়; রাক্ষস আমাদের মধ্যেই থাকে-তা হল-আমাদের কুবুদ্ধি, কুপ্রবৃত্তি। এই ভ্রান্তবুদ্ধি সমাজে যেমন নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে তেমন নিজের জীবনেও করুণ পরিণতি ডেকে আনে।
হিরণ্যকশিপু, হোলিকা তারই প্রতিরূপ। গীতার ৯ম অধ্যায়ের ১২ শ্লোকে ভগবান স্পষ্ট করে বলেছেনঃ
মোঘাশা মোঘকর্মাণো মোঘজ্ঞানা বিচেতসঃ।
রাক্ষসীমাসুরীং চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং শ্রিতাঃ।।
যারা আসুরিক স্বভাবের, মোহে অন্ধ তাদের সব আশা, কর্ম, জ্ঞান বিফলে যায়। হোলিকার তাই হয়েছিল।
আবার ভগবান ২২ শ্লোকে বলছেনঃঅনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।
সচ্চিদানন্দে আত্মসমর্পণকারীর অপ্রাপ্য বিষয় ভগবান বহন করেন, এবং প্রাপ্য বিষয় তিনিই রক্ষা করেন।বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ তাই রক্ষা পেলো। হোলিকা এখানে কুবুদ্ধি, প্রহ্লাদ সুবুদ্ধি।
ঋতু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে চাঁচর উৎসবঃ
বিশ্ববিধাতার আনমনের খেলা এই লীলাচঞ্চল প্রকৃতি। ঋতুদের শুধু আসা আর যাওয়া তাঁরই লীলা।
উত্তরায়ণে সূর্যের অবস্থান একটু এগোলেই শীতের বুড়ি লোটাকম্বল নিয়ে পাত্তাড়ি গোটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাক্ষসী বুড়ির হাড়কাঁপানো উত্তুরে নিঃশ্বাসে গাছের পাতাগুলো চোখের জলে ঝরে যায়।হত যৌবন ন্যাড়া গাছের তলায় ঝরাপাতার সব রস রাক্ষসী শুকনো জিভে শুষে নেয়। বদ্ধ ঘরে জবুথবু প্রাণ দখিনা বাতাসের একটু দাক্ষিণ্যের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। তখন বসন্ত এসে বলে”বাইরে এসো,আমি এসেছি।’বলে, “জড়তা-তামস হও উত্তীর্ণ/ক্লান্তিজাল করো দীর্ণবিদীর্ণ —“। অবরুদ্ধ প্রাণ তখন মুক্তির আশায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বলেঃ
” ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।
একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো।”
ইন্দ্রিয়ের আসক্তিজনিত কর্ম ও সুখ হল “ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা”। কারণ এগুলির পরিণাম দুঃখদায়ক। তাই এগুলি শীতের সঙ্গে তুলনীয়। মানবাত্মা চিরকালই সত্যের অভিমুখী। তাই বসন্তের আগমনের প্রাক্কালে শুকনো পাতাকে জ্বালানোর মধ্য দিয়ে আমরা আসক্তির বিনাশের প্রতীকী সাধনা করি।
শীত আবদ্ধতার প্রতীক,বসন্ত বিকাশের,শীত শূন্যতার,বসন্ত পূর্ণতার, শীত সংকীর্ণতার,বসন্ত মিলনের,,শীত আসক্তির বন্ধন, বসন্ত মুক্তির,শীতে অহংবোধের গ্লানি,বসন্তে পারমার্থিক আনন্দ।শীত আসুরিক, বসন্ত মধুর দৈবী ভাবের।
এই তাৎপর্যই লুকিয়ে আছে চাঁচর তথা বুড়ির ঘর পোড়ানো, ন্যাড়া পোড়ানো বা মেড়া পোড়ানোয়।
উপসংহারঃ মোটের ওপর, মনের অনলে অহংবোধকে বা ইন্দ্রিয়াসক্তিকে পুড়িয়ে আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে পরমসত্তার মহাজ্ঞান লাভের সাধনার অভিব্যক্তি চাঁচর উৎসবে আরোপিত।
চাঁচর উৎসবের প্রাক্কালে পরম প্রেমময় ঈশ্বরের কাছে আমাদের প্রার্থনা হোকঃ
ওঁ অসতো মা সদগময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়
আবীরা বীর্ম এধি।।
হে করুনাময়! আমাদের অসৎ পথ থেকে সৎ পথে নিয়ে চল, অন্ধকার হতে আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু থেকে অমৃতের পথে নিয়ে চল। হে ভগবান, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ হোক।।
ওঁ শান্তি!শান্তি! শান্তি!!

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।