আঞ্চলিক ইতিহাসকার ও পুরাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড.প্রণব রায় [১৯৩৬-২০২১]

ড. পুলক রায়: দাসপুরের নক্ষত্র পতন! আঞ্চলিক ইতিহাসকার ও পুরাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. প্রণব রায় মারা গেলেন। ৩০ অক্টোবর কলকাতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে আঞ্চলিক ইতিহাসের একটি যুগের অবসান হল বলা যেতে পারে।স্ত্রী সাধনা রায় প্রয়াত হয়েছেন অনেক আগেই। মৃত্যুকালে তিনি পুত্র অর্ণব রায় ও কন্যা পাপিয়া রায় সহ অন্যান্য পরিজনদের

রেখে গিয়েছেন।
আঞ্চলিক ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব, মন্দির, মসজিদ স্থাপত্য-ভাস্কর্য নিয়ে গবেষণা করে দেশ-বিদেশের বহু সম্মানে সম্মানিত লন্ডনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো তথা এফ.আর.ও.এস এবং বিশ্ববিখ্যাত কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির মর্যাদা সম্পন্ন ফেলো তথা এফ.এ.এস প্রাপ্ত অধ্যাপক ড. প্রণব রায় অবিভক্ত মেদিনীপুরের সুসন্তান ছিলেন। ১৯৩৬ সালের ২ এপ্রিল ঘাটাল মহকুমার দাসপুরের বাসুদেবপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাংলার আদি কবি কৃত্তিবাস ও মহাকবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের সুযোগ্য বংশধর পরিব্রাজক পঞ্চানন রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র প্রণববাবু পশ্চিমবাংলার বহু বিখ্যাত সরকারি ও

বেসরকারি কলেজে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করার পাশাপাশি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রূপে এবং দেশের ইতিহাস সংস্কৃতি, প্রাচীন স্থাপত্য ভাস্কর্য ও লোকসংস্কৃতি গবেষণায় একজন অসাধারণ কৃতি মানুষ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
পৃথিবীর দুটি বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ‘ফেলো’র মর্যাদা অখণ্ড মেদিনীপুরের আর কোনও সুধীজন লাভ করতে পেরেছেন কিনা জানা নেই এবং পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পর ঘাটাল মহকুমার তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এশিয়াটিক সোসাইটির ‘ফেলো’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রণব রায় এই সম্মান পেয়েছিলেন ২০০১ সালের ১৪ মে এবং ২০০৪ সালে। অত্যন্ত মেধাবী প্রণব রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্বর্ণপদক জুবিলি ও ইউজিসি বৃত্তি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে বহু সংস্কৃত নাটকে অভিনয়ের পারদর্শিতা এবং তৎকালীন পণ্ডিত যতীন্দ্র বিমল চৌধুরী, ড. রমা চৌধুরী, পণ্ডিত গৌরীনাথ শাস্ত্রীর স্নেহধন্য প্রণববাবুকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠাতে চেয়েছিলেন ড. শাস্ত্রী। কিন্তু তিনি তাঁর বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পুরাতত্ত্ব ইতিহাস গবেষণায় মনোনিবেশ করেন।
শুরু হয় পুঁথি সংগ্রহের নেশা। পুরাবস্তু নিয়ে গবেষণা। পল্লিবাংলার গ্রামে গ্রামে শুরু করলেন পরিক্রমা। ঘাটালের একটি গ্রাম থেকে সংগ্রহ করলেন মধ্যযুগের কবি অকিঞ্চন চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য সহ বিভিন্ন পুঁথি। এছাড়াও গবেষণার কাজে উদ্বুদ্ধ হলেন প্রাচীন কিছু নথিপত্র আবিষ্কার করে। অধ্যাপক রায়ের মূল্যবান আবিষ্কার চন্দ্রকোণা থানার মাধবপুর থেকে এক প্রাচীন শিলালিপি। যেটি ৯০০ বছরেরও বেশি পুরানো। এই প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার করিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশও করেন। কলকাতায় চাকরি সূত্রে বসবাসের করলেও মন্দির গ্রামবাংলায় তাঁর ঘরবাড়ি।
অধ্যাপক ড. রায়ের প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘ঘাটালের কথা’ বইটি ‘মেদিনীপুর জেলার প্রত্নসম্পদ’ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এই বইটির শেষ পরিচ্ছেদটি তাঁর বাবার সহযোগে লেখা। ‘বাংলার খাবার’ (১৯৮৭), ‘বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য’(১৯৯৯), এই গ্রন্থখানির জন্য রাজ্য আকাদেমির সম্মান অর্জন করেছেন। ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস’(২০০৯), ‘মেদিনীপুর ইতিহাস সংস্কৃতির বিবর্তন’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলির সম্পাদক,লেখক ছিলেন তিনি। সুবিশাল ‘কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস’ গ্রন্থটির প্রকাশ তিনি দেখে যেতে পারলেন। ‘বাংলার মন্দির চর্চা’ (১৯১৭) তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ, এর মধ্যে ‘জাতক কথা’ কয়েকটি খণ্ডে এবং স্কুল পাঠ্য হিসেবে ‘ইতিহাসের হারানো গল্প’ তার অন্যতম সৃষ্টি। এছাড়াও কয়েক শতাধিক মূল্যবান গবেষণামূলক প্রবন্ধ একসময় ভারতবর্ষের প্রথম শ্রেণির পত্রিকায় তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রাম বাংলার ছোট ছোট লিটিল ম্যাগাজিন থেকেও মুখ ঘুরিয়ে থাকেননি তিনি। দুটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়, মেদিনীপুর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন তাঁর অনন্য সাধারণ কর্ম কৃতিত্বের জন্য।
সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পল্লিবাংলার গ্রামে গ্রামে ইতিহাস সংস্কৃতি পুরাতত্ত্বের অনুসন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। সংগ্রহ করেছেন ইতিহাস পুরাতত্ত্বের অমূল্য সম্পদ। তাঁরই উদ্যোগে তাঁর পিতৃদেবের নামে স্বগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন পরিব্রাজক পঞ্চানন সংগ্রহশালা। ঐতিহাসিক জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো ওই সংগ্রহশালাটি দাসপুর তথা মেদিনীপুরের একটি ল্যান্ডমার্ক বলা যেতে পারে। এহেন একজন ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে সাহিত্য গবেষক মহলে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে বলে মহকুমার সাহিত্যিকরা মন্তব্য করেছেন। হয়তো এই শূন্যতা আর কোনও দিনও পূরণ হবে না।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।