ক্ষীরপাইয়ের বাবরসা আর রাজস্থানের ঘেভারের আদৌ কি তফাৎ আছে?

সন্দীপ দে: খাদ্য রসিক মিষ্টি প্রিয় বাঙালির সাধের বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে কত জানা-অজানা মিষ্টি। বিভিন্ন সময়ে সে সবের কিছু কিছু জাতে উঠেছে, কিছু কিছু আবার হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। স্থান বিশেষে এই সব মিষ্টি এখনও পাওয়া যায় আবার কেউ কেউ জিআই(Glycaemic Index)-ট্যাগও পেয়েছে।
আজ আমাদের আলোচ্য মিষ্টি [‘স্থানীয় সংবাদ’-এর সমস্ত কিছু জানতে এখানে ক্লিক করুন]বাবরসাকে নিয়ে। ধুঁকতে ধুঁকতেই আজও স্বাদ ছড়াচ্ছে বাবরের স্মৃতিধন্য ‘বাবরসা’। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার ক্ষীরপাইয়ের এক সময়ের প্রসিদ্ধ এই মিষ্টির নাম হয়ত

জেলার বাইরে হাতে গোনা কিছু লোক শুনে থাকবেন। প্রচারের অভাবে বাবরসা আজ রীতিমত লুপ্তপ্রায় হলেও এর স্বাদ আর ইতিহাস দুটোই বেশ চমকপ্রদ। এই বছরের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হওয়া আমাদের কুইজ ফেস্টের সমস্ত বিজয়ী ও অতিথিদের আমরা ঘাটালের ঐতিহ্যবাহী এই বাবরসা-ই তুলে দিয়েছিলাম।
বাবরসার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে প্রধানত দু’টি গ্রহণযোগ্য ঘটনা উঠে আসে। এক,বাবরসা নাম শুনেই হয়ত মনে পড়বে মুঘল সম্রাট বাবরের নাম। সেখানে অবশ্য জড়িয়েও আছেন তিনি। কিছু জনের মতে, মেদিনীপুরের ক্ষীরপাইয়ের এই প্রসিদ্ধ মিষ্টি নাকি খেয়েছিলেন স্বয়ং

বাদশা বাবর। উপহার হিসেবে এই মিষ্টি পাওয়ার পর খেয়ে খুব তারিফ করেছিলেন মুঘল বাদশা। সেই থেকেই নাকি মিষ্টির নাম হয়ে যায় ‘বাবরসা’। অবশ্য অপর মতটি একেবারেই অন্য। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্ষীরপাইয়ের স্থানীয় সংগ্রাম। তখন সময়টা ১৭৪০-১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি। শান্ত ক্ষীরপাই হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠল। গ্রামে আক্রমণ করল বর্গিরা। ক্ষীরপাই জনপদ লুটপাট শুরু করে মারাঠা দস্যুর দল। তাদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ হয়ে ও আতঙ্কে যখন স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষীরপাই ছাড়তে আরম্ভ করেছে, তখনই তাদের পাশে এসে দাঁড়ান ইংরেজ অফিসার এডওয়ার্ড বাবরস। ওই সাহেবের সহায়তায় সেই বর্গিদের হারিয়ে ক্ষীরপাইকে বর্গীমুক্ত করা সম্ভব হয়। তখনই, এডওয়ার্ড বাবরস সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রদান করতেই পরান আটা নামের এক স্থানীয় মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী নতুন মিষ্টি বানিয়ে উপহার দেন। অনেকে মনে করেন, সেইদিনই বাঙালি পায় এই বিশেষ মিষ্টি। বাবরস সাহেবের নাম থেকে মিষ্টির নাম হল ‘বাবরসা’। দ্বিতীয় মতটি বেশি গ্রহণযোগ্য বলে অনেকেই মনে করেন।
ক্ষীরপাইয়ের স্থানীয় এই মিষ্টি ‘বাবরসা’-র সঙ্গে সুদূর উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজস্থানের নিজস্ব মিষ্টি ‘ঘেভারের’-এর(Ghevar) অদ্ভূত মিল আছে। বস্তুতঃ বাবরসা ও ঘেভারের উপকরণ তথা প্রস্তুত প্রণালীর মধ্যে পার্থক্য প্রায় নেই বললেই চলে। পার্থক্য যেটুকু আছে, তা আকৃতিতে। আর ঘেভার কড়াই থেকে ভেজে তুলে সিরা বা চিনির রসে ডুবিয়ে শুকনো করে বিক্রি করা হয় আর বাবরসা তেলে ভাজার পর আলাদা করে তুলে রাখা হয় এবং পরিবেশনের সময়ে ওপর থেকে চিনির রস ঢেলে দেওয়া হয়। ঘেভারের তুলনায় বাবরসা একটু বেশি ভঙ্গুর।
বাবরসা প্রস্তুতকারকদের সাথে কথা বলে যা জানা গিয়েছে, বাবরসার প্রধান উপকরণ হলো দুধ, ময়দা আর চিনি। তবে বেশ কিছুকাল আগে এই বাবরসা ঘিয়ে ভেজে মধুর সঙ্গে পরিবেশিত হতো, কিন্তু বর্তমানে ক্রেতাদের বদলে যাওয়া চাহিদা, মধুর অপ্রতুলতার কারণে চিনির রস দিয়ে কাজ চালানো হয়। ময়দা, ঘি আর মধুর জোটে এই মিষ্টি যাকে বলে অমৃত। দেখতেও খানিকটা মেচেদার বিখ্যাত অমৃতির মতো। গরম ঘি-এর ওপর নির্দিষ্ট ছাঁচে ফোঁটা ফোঁটা ময়দা ঢেলে তৈরি হয় বাবরসা-র নকশা-আদল। কেউ কেউ আবার কাজু বাদামের গুঁড়ো মেশান। তবে বর্তমানে এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে ঘিয়ের বদলে ডালডাতেই ভাজা হয়। তারপরেই খদ্দেরকে পরিবেশন করার সময় আলাদা করে মধু বা চিনির রস ঢেলে ওই মচমচে জিনিসটির উপর দিয়ে পরিবেশিত হয়।
অনন্য স্বাদের-জিভে জল আনা এই মিষ্টির একটা সময় কদর ছিল সারা বাংলায়। শুধু বাংলায় কেন, অন্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল এটি। কিন্তু আজ? বহু লোক নামই জানে না প্রায় ২৫০ বছর পুরনো এই মিষ্টির। এর অন্যতম কারণ, রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ-সহ বাংলার অন্যান্য ঐতিহ্যশালী মিষ্টির মতো প্রচার কখনোই সেভাবে পায়নি ক্ষীরপাইয়ের বাবরসা। হয়তো অন্য নানা জায়গাতেও চাহিদা মতো এই মিষ্টি মিললে প্রচার মিলত। তাছাড়া, এই মিষ্টি তৈরিতে খরচও বেশি। ফলে, বাবরসার দামও বেশি। মফস্বলে এত দামি মিষ্টি সহজে কেউ কিনতে চান না। ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাদ সবকিছুর পরেও তাই বাবরসা ক্রমে তার জায়গা হারাচ্ছে। খরচ কমাতে মধুর জায়গা নিচ্ছে চিনির সিরা, ঘিয়ের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে ডালডা। এতে নিজের স্বাদও হারাতে বসেছে এই ঐতিহ্যশালী মিষ্টি। প্রচারের চূড়ান্ত অভাব, দাম না মেলা,বাঙালির স্বাস্থ্য সচেতনতা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি তথা দুষ্প্রাপ্যতা, দক্ষ কারিগরের অভাব,কারিগরদের মজুরি বৃদ্ধি এই সমস্ত কিছুর চাপে জর্জরিত বাবরসা। মার খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
ক্ষীরপাইয়ের অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন বাবরসা বানানো। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আকৃষ্ট হচ্ছে না সেভাবে। এভাবেই, স্রেফ অবহেলায় মুছে যাওয়ার উপক্রম বাবরসার। ক্ষীরপাইয়ের মিষ্টান্ন বিক্রেতাদের দাবি, অবিলম্বে জিআই-ট্যাগ দেওয়া হোক বাবরসা’কে। প্রসারণ ঘটানো হোক ব্যবসার। বাবরসা প্রচারের আলোয় ফিরুক, তার ইতিহাস সামনে আসুক। দরকারে উদ্যোগী হোক সরকার। ব্যবসায়ীদেরও প্রোডাক্টের প্যাকেজিং এবং প্রেজেন্টেশন নিয়ে উন্নতি প্রয়োজন। তাহলেই বিক্রি বাড়বে, মানও ঠিক রাখা যাবে। ঐতিহ্য বজায় রেখেই বেঁচে থাকবে ক্ষীরপাইয়ের গৌরব। আর তা না হলে, অচিরেই বাংলা হারাবে বাবরসা-কে।
কখনও যদি আপনি ঘাটাল-কামারপুকুর-চন্দ্রকোণার সংযোগস্থলে ক্ষীরপাই শহরের হালদারদিঘির ওপর দিয়ে যান, তবে অবশ্যই একবার এই বাংলার অনুপম মুখরোচক ঐতিহ্যের স্বাদ গ্রহণ করতেই পারেন। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, বাবরসা খেতে মন্দ লাগবে না। স্বাদ পাওয়ার পর আপনিও সুপরিচিত সেই বিজ্ঞাপনের ঢঙে বলবেন,‘অল্পেতে স্বাদ মেটে না, এ স্বাদের ভাগ হবে না’। কীভাবে যাবেন? কলকাতার ডানলপ বা হাওড়া থেকে যেকোন চন্দ্রকোণাগামী বাসে হালদারদিঘি স্টপেজ।
[সন্দীপ দে’র বাড়ি দাসপুর-১ ব্লকের চাঁদপুরে। পেশায় সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। টিসিএসের নিউটাউন শাখায় কর্মরত। মো:৯৭৩২৯৩৯৭৩৭ ♦সন্দীপ দে’র ফেসবুক https://www.facebook.com/sandipju]

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।