‘ঘেঁটুপুজোর উদ্ভব ঘেঁটু ষষ্ঠী বা ঘেঁটু পূজা’ —দেবাশিস কুইল্যা

‘ঘেঁটুপুজোর উদ্ভব ঘেঁটু ষষ্ঠী বা ঘেঁটু পূজা’ —দেবাশিস কুইল্যা

শোন শোন সর্বজন  ঘাঁটুর জন্ম বিবরণ/পিশাচ করলে জন্মিলেন শাস্ত্রে লিখন।/বিষ্ণুনাম কোনমতে করবেনা শ্রবণ/তাই দুই কানে দুই ঘণ্টা করেছে ধারণ।
গ্রাম বাংলার লোকমুখে লোকদেবতা ঘণ্টাকর্ণ ঘেঁটু নামে পরিচিত।  পুরান ও শাস্ত্রীয় মতে,  এই লৌকিক দেবতা দেবকুমার স্বর্গে থাকা অবস্থায় বড়সড় অপরাধের কারণে বিষ্ণুর অভিশাপে পিশাচ কূলে ঘণ্টাকর্ণ নামে জন্ম হয় খোস-পাঁজরা, চুলকানি-র মত নানান চর্মরোগের অপদেবতা হিসেবে। কথিত আছে এই ঘণ্টাকর্ণের পূজা করলে নানান চর্মরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
শুধু  মনেকরা নয় , বাংলাদেশের নানাপ্রান্তে  ঋতু পরিবর্তনের সময়কালে  খোস চুলকানি-র মতো বিভিন্ন  চর্মরোগের  প্রাদুর্ভাব দেখা যায় । এই  চর্মরোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ জনজাতির বিশ্বাস  থেকে ঘেঁটু ঠাকুরের পূজার উদ্ভব বলে ধরে নেওয়া যায়; মত  লোকসংস্কৃতি গবেষক  পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ।
ঘেঁটুপুজোর জন্য প্রয়োজন হয় ঘেঁটু ফুলের ; যা বাংলাদেশের বসন্ত ঋতুতেই ঝোপঝাড় আলো করে ফুটে উঠে । এই ঘেঁটুফুলের প্রাচুর্যতা ও ঘেঁটুগাছের ওষধিগুনের কারণেই ফাল্গুন সংক্রান্তির দিন অবিভক্ত বর্ধমান, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশ, হুগলি, দুই ২৪ পরগনা সহ  প্রভৃতি জেলায় ঘেঁটু বা ঘণ্টাকর্ণ পূজার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই ঘেঁটুকে লোকসংস্কৃতি গবেষক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু ‘আর্যেতর সমাজ থেকে উদ্ভুত অপ্রধান লৌকিক দেবতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে লোক-গবেষকরা মনে করেন, ঘেঁটুপূজার র উদ্ভবের কারণ, ঋতু পরিবর্তনের সময়কার চর্মরোগের হাত থেকে মুক্তি প্রার্থনা। সাধারণ ভাবে আমাদের দেশে ঋতু পরিবর্তনের সময়  খোসপাঁজরা, চুলকানি-র মতো নানা চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যই ঘেঁটু ঠাকুরের পূজার উদ্ভব বলে মনে করা হয়।
ঘেঁটুর স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে তেমন কোনও শাস্ত্রীয় রীতিনীতির উল্লেখ নেই। এই দেবতার পূজার উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস জানতে  ঘেঁটু পূজার পাঁচালি ও  লোককাহিনির উপরেই নির্ভর করতে হয়। কথিত আছে,  আজীবন বিষ্ণুর  অভিশাপের বোঝা বয়ে বেড়ানোর জন্য তিনি ঘোরতর বিষ্ণু বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। এমনকি, বিষ্ণুর নাম পর্যন্ত যাতে শুনতে না হয়, সে জন্য তিনি কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন। সেই থেকেই ঘেঁটুর অপর নাম হয় ‘ঘণ্টাকর্ণ’। তবে কী কারণে ঘেঁটু চর্মরোগের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন তা নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া  না গেলেও অনেকে মনে করেন, সূর্যের লৌকিক সংস্করণ হলেন ঘেঁটু। সূর্যের আলোয় চর্মরোগ সারে এই বিশ্বাস থেকেই সাধারণ জনজাতির মানুষের মনে হয়েছিল সূর্যকে তুষ্ট করতে পারলেই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সেই ধারনা থেকেই ঘেঁটু পূজার উদ্ভব ও বিকাশ। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যায় সূর্যের উত্তরায়ণ শুরুর পর থেকেই রৌদ্রের তাপ বাড়তে শুরু করে ও প্রখর হয় । সূর্যের আলো নানান জীবানুনাশক এই সত্য থেকে সূর্যের অন্য সংস্করণ মনে করেই লোকদেবতা ঘেঁটু বাঘণ্টাকর্ণের পূজার উদ্ভব ।
লোকপ্রচলিত পূজা পদ্ধতি অনুসারে দেখা যায় ঘেঁটুর কোনও নির্দিষ্ট মূর্তি নেই। কোথাও কোথাও একটি ভুষাকালি মাখা মাটির হাঁড়িকে ঘেঁটুর প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয় । সেই হাঁড়িকে ফাল্গুন সংক্রান্তির দিনে বিগ্রহ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় । আর  সাজানো হয় গোবর, কড়ি, তেল-হলুদ মাখানো কাপড়ের টুকরো , সিঁদুর এবং অবশ্যই ভাটফুল বা ঘেঁটুফুল দিয়ে । মেয়েরা সামনে বসে ছড়া কেটে চাল, গুড় ইত্যাদি অর্ঘ্য হিসেবে দেবতাকে নিবেদন করে। কোথাও আবার পুরোহিত দিয়ে শাস্ত্রীয় মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেও পূজা করা হয়।
ফাল্গুন সংক্রান্তির দিনে পূজার  শেষে পাড়ার কমবয়েসি ছেলেমেয়েরা বাঁশের লাঠি দিয়ে ভুষোকালি মাখানো হাঁড়িটিকে ভেঙে দেয়। এই পূজার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে  অনেক লোকসংস্কার । প্রচলিত নিয়মে, যাঁরা ভুষোকালি মাখা হাঁড়িটিকে ভাঙে তাঁদের হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। হাঁড়ির ভুষো জোগাড় করে কাজলের মতো করে চোখে পরার রীতিও কোনও কোনও জায়গায় প্রচলিত রয়েছে। লোকবিশ্বাস, এতে চর্মরোগের সঙ্গে সঙ্গে চক্ষুরোগের আশঙ্কা কমে। অনেক সময় গোবর ডেলা পাকিয়ে মুখের‌ আদলে তৈরি করে ঘুঁটে দেওয়ার মতো করে রাখা হয় বাড়ির সদর দরজার পাশে। এই মুখের আদলে কড়ি আর সিঁদুর দিয়ে নাক ও চোখ তৈরি করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, এই মূর্তি বাড়ির দেওয়ালে রাখলে রোগ জীবাণু এবং অশুভ শক্তি গৃহে প্রবেশ করতে পারবে না।
ফাল্গুন সংক্রান্তির সকালে ঘণ্টাকর্ণ বা ঘেঁটু পূজা অনুষ্ঠিত হয়। লোকদেবতা ঘেঁটুর নির্দিষ্ট মন্দির বা স্থান  নাথাকার কারণে জলাশয়ের পাশে বা নদীর ধারে পূজা করা হয় । নির্দিষ্ট মন্ত্র বা আচার বিবর্জিত হওয়ায় জন  মূলত গৃহস্থের বয়স্ক মহিলা এলোচুলে বা পুরুষ পূজা করে থাকে। উপকরণ হিসেবে মুড়ি ভাজার পুরনো খলা বা ধানসেদ্ধ করার  পুরনো হাঁড়ি , যা কেলে হাঁড়ি নামে পরিচিত ; তেল হলুদ চোবানো  সাদা কাপড়,  তিনটি কড়ি, গোবর পিণ্ড আর একমাত্র  ঘেঁটু ফুল। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ঘেঁটুর প্রতীক হিসেবে মাটির তৈরী খলা, ভুষোকালি মাখা হাঁড়ি, হলুদ,  তেল,  সব প্রতীকেই জড়িয়ে রয়েছে আগুনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি। অনুজ্জ্বল আগুনের এই উপস্থিতির  রোগ প্রতিরোধের  উপায়। ঘেঁটু পূজার জন্য ঘেঁটুফুল গাছ বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায় যে, মানুষের চর্মরোগের  জন্য ঘেঁটুর ওষধি মূল্য গুণাতীত। ঘেঁটুপূজার র সময় ছড়া কাটা হয়:ধামা বাজা তোরা কুলা বাজা/এলো এলো ঘরে ঘেঁটু  রাজা ।
এছাড়াও: আলোর মালা চাল দাও/নয় খোস পাঁজড়া দাও/যে দেবে ধামা ধামা/ তারে ঘেটু দেবে জরির জামা।
ঘেঁটুপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঘেঁটুর গানের অনুষঙ্গ। কিছুদিন আগেও উল্লিখিত জেলার গ্রামগুলিতে সন্ধ্যায় গৃহস্থের ছেলেরদল ‘ঘেঁটুর গান’ গেয়ে বেড়ায় । পাড়াগাঁয়ে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা কলাগাছের কাণ্ডের বাকলের স্তর বা ‘কলা বাসনা’ কেটে ডুলি তৈরি করে ঘেঁটুফুলে  সাজিয়ে তার ভিতরে একটা প্রদীপ বসিয়ে  সেটিকে একটি লম্বা কাঠিতে সেই ডুলিকে ঝুলিয়ে দু’জন তার দু’টি প্রান্ত ধরে কাঁধে করে নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে  ঘেটুর গান গেয়ে বেড়াত।  উঠোনে দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে বলতে থাকে, ‘যে দেবে মুঠো মুঠো/তার হাত  হবে ঠুঁটো/যে দেবে কড়াই কড়াই/তার ঘরে সোনা ছড়াই।’/ঘেঁটুকে নিয়ে অন্য এক প্রচলিত ছড়া শোনা যায় ।
যেমন ; ঘেটু যায় ঘেটু যায় গৃহস্থের বাড়ি/এক কাঠা চাল দাও কুমড়োর বড়ি ।/যে দেবে থালা থালা/তার হবে কোঠা বালা।/যে দেবে মুঠো মুঠো/তার  হবে হাত ঠুটো।/যে দেবে এক পলা তেল/তার হবে সোনার দেল।/যে দেবে শুধু বকুনি/ঘেটু দেবে খোস চুলকানি।
এ ভাবে সংগৃহীত  চাল ও পয়সা  পূজার পরে কোনও এক দিন সবাই মিলে  ভোজেে মেতে ওঠে। বিশেষকরে অল্প বয়সীদের গ্রামে গ্রামে  এই দিনে আনন্দ উন্মাদনায় মেতে উঠতে দেখা যেত  প্রায়    আড়াই  – তিন দশক আগে পর্যন্ত।  ছেলেমেয়েরা ছড়াগানের ঠিক অর্থ না বুঝলেও পরিবেশ আর পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুর আর কথায় তাৎক্ষণিক গান বানিয়ে ফেলাও  তাদের পক্ষে কঠিন ছিলনা। তাতে যে কখনও কখনও অর্থ বিপর্যয়  হলেও  পূজার ব্যাঘাত  হত তেমনটা নয়। যেমন, ‘‘যে দেবে বাটি বাটি/ তার কাজ হবে মাটি’।
বর্ধমান ও হুগলির অনেক গ্রামে বয়স্কদেরও ঘেঁটুর দল  লক্ষ্য করা যেত। হারমোনিয়াম, খোল, করতাল, বাঁশি সহযোগে হরিনাম সঙ্কীর্তনের মতো ফাল্গুন সংক্রান্তির দিনে তাঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরত। মুখে মুখে সহজেই ছড়া তৈরি করার ক্ষমতা রাখত । সেসব ছড়াগানের মাধ্যমে উঠে আসত সমকালীন নানা সমস্যার কথা। আবার স্থানীয় পাড়া, প্রতিবেশীদের সম্পর্কেও বিভিন্ন রসাত্মক ও ব্যঙ্গাত্মক প্রসঙ্গও বাদ যেত না। সব মিলিয়ে ঘেঁটুকে উপলক্ষে রীতিমতো বিনোদনের আবহ তৈরি হত গ্রামবাংলায়।
জলাশয় বা বড় পুস্করণী অথবা নদীর পাড়ে জনাকীর্ণ স্থানে ঘেঁটু পূজার শেষে সন্ধ্যার অন্ধকার গভীর হওয়ার আগেই অর্থাৎ সাঁঝবেলায় হইহই করতে করতে ছড়া কাটতে কাটতে ঘেঁটুর বিসর্জন সাঙ্গ হয় । বিসর্জনের সময় সুর করে গাওয়া হয় ; ভাগ্যবানে কাটায় পুকুর চণ্ডালে কাটে মাটি/কুমোরের কলসি আর কাঁসারির ঘটি/জল শুদ্ধ, স্থল শুদ্ধ, শুদ্ধ মহামায়া//হরিনাাম করলে পরে শুদ্ধ হয় কায়া।
অর্থাৎ,  এই  লৌকিক দেবতার পূজার আয়োজনের সাথে জড়িয়ে আছে সাধারণ  মানুষের বেঁচে থাকার সহজ উপকরণের সাথে রোগ জীবাণুর হাত থেকেও  মুক্তির উপাদান।  পূজার উপকরণ ও তার আয়োজনের মধ্যেই নিহিত আছে সে সত্য।কালের নিয়মে ঘেঁটু সংক্রান্তি প্রতি বছর আসে । সময়ের আবেদন খারিজ করে দেয় অন্যান্য লৌকিক আচারের সাথে অনেকদিন জড়িয়ে থাকা এই  লৌকিক দেবতার পূজার আচার অনুষ্ঠান।তথ্যসূত্র:-
১ ) বাংলার  লোক সংস্কৃতি অভিধান- আশুতোষ ভট্টাচার্য
২) বাংলার লৌকিক দেবদেবী সংখ্যা – মেঘবল্লরী ; সম্পাদক         প্রাণনাথ শেঠ ।
৩) লৌকিক দেবদেবী –  অজয় মণ্ডল ।
দেবাশিস কুইল্যা , @ ৫বেড়িয়া , থানা – দাসপুর,  জেলা-  পশ্চিম মেদিনীপুর ।

 

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।