‘কাজী নজরুল ইসলামের প্রেম’ —উমাশংকর নিয়োগী

‘কাজী নজরুল ইসলামের প্রেম’ —উমাশংকর নিয়োগী
🌹
অনামিকা❤️
প্রথম প্রেম ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ। কাজী নজরুল ইসলাম তখন ক্লাস টেনের ছাত্র। বয়স আঠারো। প্রিটেস্ট পরীক্ষার পর বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে সৈন্যদলে নাম নথিভুক্ত করতে যান। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় শৈলজানন্দ বাদ পড়েন। পিছুটানহীন নজরুল সৈন্যদলের অন্তর্ভুক্ত হলেন। সৈন্য বিভাগে যে সম্পদগুলো তিনি সযত্নে রক্ষা করতেন তার মধ্যে একটি মাথার কাঁটা ছিল। এই কাঁটাটি কার নজরুল তা কোনদিন প্রকাশ করেননি। নজরুলের জীবনীকারেরাও কোথাও নাম উল্লেখ করেননি।অথচ মাথার কাঁটার অধিকারিণীকে অবলম্বন করে নজরুলের ‘ব্যথার দান’ রচিত একথা সবাই স্বীকার করেছেন। ব্যথার দানের উৎসর্গ পত্রে নজরুল ইসলাম লিখেছেন, “মানসী আমার! মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম।”
🌹কবি নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় প্রেম, প্রথম বিয়ে❤️
১৭ ই জুন ১৯২১ , ৩ রা আষাঢ় ১৩২৮ । শুক্রবার। স্থান দৌলতপুর। মুরাদপুর, কুমিল্লা। পাত্রী: সৈয়দা খাতুন। পিতা: মুন্সি আব্দুল খালেক । মাতাঃ আস্মতুন নেসা । মামাঃ আলী আকবর খান ।
তখন নজরুলের বয়স ২২ বছর । অসামান্য সুন্দরী তরুণী সৈয়দা ১৬ । বই ব্যবসায়ী আলী আকবরের পরিচয় সূত্রে কুমিল্লার খরস্রোতা গোমতী নদী তীরে এক গ্রাম দৌলতপুরের মুন্সি আব্দুল খালেকের বাড়ি আসেন নজরুল ইসলাম। প্রথম দর্শনেই সৈয়দার ” তন্বি নয়নে বহ্নি ” কবির হৃদয়ে ছ্যাঁকা লাগিয়ে দেয়। ” ষোড়শীর হৃদি – সরসিজ প্রেম উদ্দাম ” করে কবিকে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ দুটো মাস এঁদো গ্রাম দৌলত পুরেই ছিলেন কবি। নজরুল খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। পল্লীবাংলার নিঝুম রাতের আকাশ , বাতাস ভাসাতেন বাঁশির মদির সুর। কেবল আকাশ বাতাস সুরে ভাসতো না , তরুণী সৈয়দার হৃদয়ের দুকূলও ভাসতো । প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আপাত দৃষ্টিতে কাছাকাছি আসে মিলনোন্মুখ দুটি হৃদয়। দু তিন মাসের নার্গিস প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া কবি নার্গিসকে নিয়ে বহু গান ও কবিতা রচনা করেন। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন,
“যেমন ছাঁচি পানের কচি পাতা প্রজাতির ডানার ছোঁয়ায় ,
ঠোঁট দুটি তার কাঁপন আকুল একটি চুমায় অমনি নোয়ায়।
মিলন মোদের স্বপন কূলে কাঁদন ভরা চুমায় চুমায় ।
নাম হারা সেই আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোঁয়ায়। ”
এই সময় কালে আর একটি কবিতাতে কবি লিখেছেন, “মণিমালার মত আমার কণ্ঠে জড়ালি / আমার পথিক জীবন এমন করে / ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি। ”
আলী আকবর তাঁর ভাগ্নীর সঙ্গে নজরুলের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। কবি সৈয়দার নাম দেন নার্গিস। কিন্তু কবি তাঁদের দাম্পত্যজীবনকে কেন্দ্রে রেখে আলী আকবরের অসৎ এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ধরে ফেলেন। কাবিননামাতে শর্ত ছিল সৈয়দা কুমিল্লা ছেড়ে কোথাও যাবেন না এই নিয়ে বিয়ের রাত্রেই তুমুল বিবাদ হয় সৈয়দার সঙ্গে। ফলে বিয়ের দিনই বিচ্ছেদ হয় । অনেকে বলেন আকদ ( বিবাহ চুক্তি ) সই হয়নি । ঢাকা থেকে প্রায় পালিয়ে বাঁচেন নজরুল।
এই ঘটনার ১৫ বছর পর সৈয়দা নজরুলের
কাছে বিয়ে করার অনুমতি চেয়ে চিঠি লেখেন। এর উত্তরে নজরুলের লেখা দীর্ঘ
চিঠিটি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। নজরুল লিখছেন,
” কল্যাণীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি- সেদিন নব বর্ষার নবঘন -সিক্ত প্রভাতে।মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনেরো বছর আগে এমনই এক আষাঢ়ে এমনই বারিধারার প্লাবন নেমেছিল – তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পার। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। *আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি-। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না- আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণ রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, সে রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়ে আছে আমার বক্ষে ।* তোমার আজকার রূপ কী,জানি না । আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয় – বেদিতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। * পাষাণ-দেবীর মতো তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদি-পীঠ । জীবন ভরে সেইখানেই চলছে আমার পূজা- আরতি। * হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনেরো বছর আগেকার কথা। তোমার জ্বর হয়ছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল ; তোমার সেই তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি, তুমি কী চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল,হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, * মনে হয় যেন কালকার কথা। মহাকাল সে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলে না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল! সারা-দিনরাত আমার চোখে ঘুম ছিল না।**।
ইতি- নিত্য শুভার্থী
নজরুল ইসলাম। ”
সৈয়দা আজিজুল হাকিমকে বিয়ে করেন ।
🌹তৃতীয় প্রেম, দ্বিতীয় বিয়ে❤️
২৪শে এপ্রিল ১৯২৪ শুক্রবার ।স্থান কুমিল্লা মানিকগঞ্জ কান্দিরপাড় , তেওতা গ্রাম
পাত্রী : আশালতা সেনগুপ্ত ওরফে দোলন / দুলি । পিতাঃ প্রয়াত বসন্ত সেনগুপ্ত। মাতাঃ গিরিবালা । কাকা বীরেন্দ্র । কাকার সূত্রে পরিচয়। দৌলতপুরে বিয়ের দিন নজরুল প্রথম দেখেন আশালতাকে।
কবির দেওয়া নাম প্রমীলা । ‘মেঘনাদবধকাব্য’ এর মধুসূদন দত্তের মানস কন্যা প্রমীলার অনুকরণে দেওয়া নাম । ১৯২১ এর জুলাই মাসের দৌলতপুরের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নজরুল ইসলাম কান্দিরপাড় তেওতা গ্রামে আসেন। ছিলেন বেশ কয়েকটা দিন। ১৯২২ , এর ৬ই জানুয়ারি ‘ বিজলী ‘ পত্রিকায় কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বেরোনোর পর বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কান্দিরপাড়ে আসেন নজরুল ইসলাম।
ধীরে ধীরে আশালতার সঙ্গে নজরুলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এখন থেকে প্রায় একশো বছর আগে এক মুসলমান যুবক একটি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করা সহজ সাধ্য ছিল না। নিজের জীবন বাজি রেখে তিনি তাঁর প্রণয়ীকে পরিণীতাতে পরিণত করেছিলেন। আশালতাকে উদ্দেশ্য করে নজরুল লিখছেন, ” আমার বিজয় কেতন লুটিয়ে পড়ে তোমার চরণ তলে এসে। ”
আশালতার মৃত্যুর পর থেকে তেওতা গ্রামে নজরুল আশালতার প্রেমকে মনে রেখে
মেলা বসে । আজও সেই মেলা চলছে ।
🌹চতুর্থ প্রেম। মেজবৌ নসরিন❤️
১৯২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দ। নজরুল কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়কের কাছে মোড়লবাগানে বসবাস করছেন। এই চাঁদসড়কের ঘটনাবলী নিয়েই তাঁর ‘মৃত্যু ক্ষুধা ‘ রচিত। মৃত্যু ক্ষুধার একটি অন্যতম প্রধান চরিত্র মেজবৌ। চাঁদসড়কের মেজবৌকে তথা নসরিনকে নজরুল অমর করতে চেয়েছিলেন। বাস্তবের হাবিবের নিঃসন্তান স্ত্রী নসরিন খুব অল্প বয়সেই বিধবা হয়। কেশবতী রূপসী দিঘল চোখের মেয়েটির খিল খিল হাসি নজরুলকে আকৃষ্ট করত। তিনি নসরিনকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে বড় উপন্যাসও লিখতে চেয়েছিলেন। এক সময়ে নসরিন নজরুলের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে।নজরুলও নসরিনের রূপ ও গুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন। নজরুলের প্রতিবেশী কৃষ্ণনগর পৌরসভার ভাইস- চেয়ারম্যান আকবরউদ্দিন বিষয়টির গভীরতা বুঝতে পেরে নসরিনের দেওয়র করিমের সঙ্গে তার বিয়ে দেবার উদ্যোগ নেন। নসরিন রাজি হয়ে যায়। নজরুলের কথায় এটা নসরিনের ‘ বড় ত্যাগ ‘। জীবনে চাঁদসড়কের নসরিনের পুনর্বিবাহের ঘটনাকে নজরুল তাঁর জীবনের বড় ট্র্যাজেডি মনে করতেন।
🌹পঞ্চম প্রেম। ফজিলতুন্নেসা❤️
করটিয়ার জমিদার বাড়ির কর্মচারী মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলির মেয়ে ফজিলতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী, যিনি গণিত বিষয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। বিদুষী ফজিলতুন্নেসা নজরুলের কাছে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশ করার জন্য ‘দুদিনের দেখা ‘ নামে একটি লেখা পাঠান । সওগাতে লেখাটি প্রকাশিতও হয়। নজরুল তাঁকে নিজের লেখা ষোলটি বই উপহার পাঠিয়ে বন্ধু মোতাহারকে একটি চিঠিতে লেখেন,” আমার বইগুলো ওকে পাঠাতে এত লজ্জা করছিল,সে কথা আর কী বলব।**বইগুলো পাঠানোর পর থেকে আমার আর অস্বস্তির অন্ত নেই। পোকা খেগো ফুল দিয়ে কি দেবতার অর্ঘ্য দেওয়া যায় ?**ওঁর শরীর কেমন? আমার কোনো কিছু ভালো লাগে না আর । এত আড্ডা গান- কিছুতেই মনকে ডোবাতে পারছিনে। এর কোথায় শেষ -কে জানে? কেবলি বিস্বাদ ঠেকছে- আলো -বাতাস হাসি-গান ! সব, কী যে হবে কী যে করব-আমি জানিনে।”
তা নজরুলের যাই হোক না কেন, তাঁর সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখেননি ফজিলতুন্নেসা। এ কি কবির এক তরফা ভালোবাসা!
১৯২৮ শের ২৫শে ফেব্রুয়ারি কবি কাজী মোতাহার হোসেনকে একটি চিঠিতে লিখেছেন, ” বড্ড বুকে ব্যথা। ভয় নেই ,সেরে যাবে এক ব্যথা। তবে ক্ষত-মুখ সারবে কিনা তা ভবিতব্যই জানে। ক্ষত-মুখের রক্ত মুখ দিয়ে উঠবে কি না জানি না ।কিন্তু আমার সুরে গানে, আমার কাব্যে সে রক্তের যে বন্যা ছুটবে তা কোনদিনই শুকোবে না ”
এই পঞ্চ কন্যার কাছে বাংলা সাহিত্যে চিরকৃতজ্ঞ।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।