মদের গ্লাস না স্পর্শ করেই ড্রাইভারির ৫০ বছর অতিক্রান্ত

সুইটি রায়👆স্থানীয় সংবাদ•ঘাটাল:•সমস্ত রকম ‘কু-নেশা’ থেকে ৫০ হাত দূরত্ব বজায় রেখে ড্রাইভারি পেশার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ অতিক্রান্ত করলেন ঘাটালের সত্যসাধন চক্রবর্তী। ‘গাড়ি চালকদের দিনের শেষে একটু নেশাভাঙ করতেই হয়’—এই ধারণাও যে পুরোপুরি ভুল, পাঁচ দশক ধরে ঘাটাল ব্লকের মোহনপুরের বাসিন্দা সত্যসাধনবাবু তা প্রমাণ করে এসেছেন।
গাড়ি চালকদের মধ্যে ব্যতিক্রমী চরিত্রের মানুষ সত্যসাধনবাবু বর্তমানে আর কোনও গাড়ি চালান না। বরাবরের জন্য স্টিয়ারিং ছেড়ে স্ত্রী বাসবি চক্রবর্তীকে নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকেন তিনি। ড্রাইভার সম্পর্কিত সমাজের চিরাচরিত ভাবনা ভেঙে সন্তানদের সুপ্রতিষ্ঠিতও করেছেন তিনি। স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে জীবনে বেশ কয়েক লক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রান্ত করার মাঝেই সন্তানদের সুপ্রতিষ্ঠ করা চোখের কোণে স্বপ্ন ছিল বলে তিনি কোনওদিনও নেশার ধারে কাছে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। সবসময় ভাবনা ছিল নিজেকে নষ্ট করলে সন্তানরা শিখবে কী? অবশ্য সন্তানরাও তাঁর ভাবনার যথার্থ সম্মান রেখেছেন। ছেলে শান্তনু চক্রবর্তী বর্তমানে মিনিস্ট্রি ইন মাইনরিটি অ্যাফেয়ারসে সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত। মেয়ে মৌসুমী চক্রবর্তী পড়ান একটি স্কুলে।
পেশায় গাড়ি চালক হলেও এই আদর্শ মানুষটিকে নিয়ে কোনও রকম হীনমন্যতায় ভোগেননি পুত্রবধূ তথা অ্যামিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর শম্পা কুণ্ডু এবং জামাই ডিস্ট্রিক্ট জজ কোর্টের অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট মৃণাল চক্রবর্তী। বরং তাঁরা বলেন, এমন শ্বশুরই আমাদের গর্ব।
সত্যসাধনবাবু নিজের কাজের জায়গাতে কখনওই ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসতে চাননি। দিতে চাননি নিজের মতো জীবন। তাই তাঁদের শিক্ষিত করেছেন উচ্চশিক্ষায়। ১৯৭১এর ১৯ এপ্রিল প্রথম ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়কে ট্যাক্সি চালানো দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর জীবন যাত্রা। দরিদ্র পরিবারের বড় ছেলে, তার ওপর রয়েছে চার বোন, ভাই আর অসুস্থ বাবা মায়ের দায়িত্ব, তাই সেখানে পড়াশোনা নিতান্তই বিলাসিতা মাত্র ফলে ক্লাস নাইনের পর আর হয়ে ওঠেনি পড়াশোনা। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে ড্রাইভিং শিখে মাত্র। কুড়ি-একুশ বছর বয়সেই ধরতে হয়েছিল ট্যাক্সির স্টিয়ারিং। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি। একে একে শিখেছেন বিভিন্নরকম গাড়ি চালানো। পেয়েছেন এল এম ভি, এইচ এম ভি,পি এস ভি এর সার্টিফিকেট। মাত্র দু-টাকার বিনিময়ে ঘাটাল থেকে পাঁশকুড়াতে সওয়ার নিয়ে গেছেন। এভাবেই কেটেছে কিছুদিন। তারপর স্বল্পবেতনের ট্যাক্সি ছেড়ে শুরু করেছিলেন লরিতে হেল্পারি করা এবং বছর দুয়েকের মধ্যেই শুরু হয় তাঁর লরিচালকের জীবন। তাঁর প্রায় ১২ বছরের লরিচালক জীবনের টানা সাত বছর তিনি লরি চালিয়েছেন ঘাটাল-মেদিনীপুর ট্রান্সপোর্টে। কলকাতা, নদীয়া, বহরমপুর, উত্তরবঙ্গ সহ আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে মালপত্র এনেছেন। তার সাথে সংগ্রহ করেছেন নানান বিচিত্র স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
অন্যান্য গাড়ি চালকদের কাছ থেকে বার বার নানা রকম কু-পরামর্শ এসেছে। কখনও মদ খাওয়ার কখনও বা নিষিদ্ধ এলাকায় যাওয়ার। লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকা সত্যসাধনবাবুকে সেই ফাঁদে কখনও ফেলা সম্ভব হয়নি।
তার ঝুলিতে রয়েছে নদীয়ার গুপ্তিপাড়ার ঘাটে নৌকোতে করে মালবোঝাই গাড়ি পার করার অভিজ্ঞতা, গাড়িতে মাল নিয়ে ফেরার পথে কখনও অসহায় লোককে বাড়ি পৌঁছতে সাহায্য করা আবার কখনও কোনও রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার অভিজ্ঞতাও। লরি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলেও পড়েছেন। বুকের হাড় ভেঙে হাসপাতালে ভর্তিও থাকতে হয়েছে। তবে তাঁর মতে তাঁর জীবনের সবথেকে স্মরণীয় ঘটনা হল ১৯৭৮ এর বন্যা। এই সময় সরকারের বরাত মতো বাঁধে মাটি দেওয়ার জন্য খালি বস্তাভর্তি গাড়ি নিয়ে কলকাতা থেকে ফেরার পথে পথমধ্যে দেখেছিলেন অসহায় বন্যার্ত মানুষদের হাহাকার। যা তাঁকে রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই সমস্ত অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে ঘাটালের বেশ কিছু মানুষকে নিয়ে তিনি কলকাতাতে ভিক্ষেও করেছেন সেই সময়। আর সেই সমস্ত সামগ্রী ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সাহায্য নিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন অসহায়দের কাছে। শুধু তাই নয় ভারত সেবাশ্রম থেকে দেওয়া ত্রাণসামগ্রীও তিনি এই সময় পৌঁছে দিয়েছেন গ্রামে গ্রামে, বন্যার্তদের বাড়ি বাড়ি। শুধু এরাজ্যে নয় ভিনরাজ্য যেমন ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ,বিহার থেকেও তিনি নিয়ে এসেছেন মালপত্র। মালবোঝাই গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে ওঠা এবং পাহাড়ি রাস্তাতে গাড়ি চালানোর অভ্যাস তৈরি হয়েছিল ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেই। ১৯৮৫ তে আসে তাঁর জীবনের নতুন মোড়, লরির স্টিয়ারিং ছেড়ে বসেন বাসচালকের আসনে। পরবর্তী জীবনের বেশিরভাগটাই তিনি হাওড়াগামী বিভিন্ন বাস চালিয়েছেন। তাছাড়াও চালিয়েছেন বিভিন্ন টুরিস্ট বাস। টুরিস্ট বাস নিয়ে মাওবাদীদের মুখোমুখি পড়ে সেখান থেকে বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতাও ভোলার নয়। তাঁর ৫০ বছরের গাড়িচালকের জীবনে দুর্ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। চোখের সামনে দেখেছেন মৃত্যুকে। কিন্তু প্রতিবারই উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন দুর্ঘটনার কারণ। বুঝতে চেষ্টা করেছেন কীভাবে তিনি এড়াতে পারতেন বিপদকে। ফলে হাত পেকেছে আরও। বেড়েছে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাও। বর্তমানে বিভিন্ন শারীরিক কারণে তিনি মোটামুটিভাবে অবসর গ্রহণ করলেও তাঁর কথায়, যদি কারও মনে হয় আমি তাঁর উপকারে লাগতে পারি তাহলে নির্দ্বিধায় সাহায্য চাইতে পারেন। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করবো। তিনি আরও বলেন, শুধু সাধারণ মানুষ নয় প্রশাসন বা সরকার যদি করোনাকালীন পরিস্থিতিতে কোনও গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স চালানোর ভার আমাকে দিতে চায় আমি সানন্দে গ্রহণ করতে রাজি। তবে সরকারের কাছে আমার আর্জি পরিবহন দপ্তরের দিকে যেন তারা কিছুটা হলেও দৃষ্টি দেন। •ছবিটি সত্যসাধন চক্রবর্তীর।

•আমাদের ফেসবুক পেজ:https://www.facebook.com/SthaniyaSambad.Ghatal/
•ইউটিউব চ্যানেল:https://www.youtube.com/SthaniyaSambad
•আমাদের সংবাদপত্রের মোবাইল অ্যাপ:https://play.google.com/store/apps/details?id=com.myghatal.eportal&hl=en
•টেলিগ্রাম চ্যানেল:https://t.me/SthaniyaSambadGhatal

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

'স্থানীয় সংবাদ'-এর সাংবাদিক। বাড়ি ঘাটাল শহরে(কুশপাতা ১৭ নম্বর ওয়ার্ড• পশ্চিম মেদিনীপুর)। আমার শহর ঘাটালের যে কোনও খবরই অবিকৃতভাবে সকলের সামনে তুলে ধরাতেই আমার আগ্রহ। •মো: 9732738015/9933998177 •ইমেল: [email protected]