‘পরকীয়া কী ও কেন? এবং মুক্তির উপায়ই বা কী?’—উমাশংকর নিয়োগী

‘পরকীয়া কী ও কেন? এবং মুক্তির উপায়ই বা কী?’ —উমাশংকর নিয়োগী
•আমজনতার বহুবিধ সমস্যার মধ্যে বর্তমানে গৃহবধুর গৃহত্যাগ একটি অন্যতম জ্বলন্ত সমস্যা । রোদনরত সন্তানের ‘ মা তুমি ফিরে এসো। ’ স্বামীর কাতর আহ্বান ‘ মাধবী! তুমি ফিরে এসো , অতীত আমি মনে রাখব না । ’ শাশুড়ির কাতর আবেদন , ‘বৌমা ! বাড়ি ফিরে এসো , তুমি যা বলবে তাই শুনবো।’ ইত্যাদি আবেদন প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের চোখে পড়ে যায় । গৃহ বধূরা স্বামী সংসার ছেড়ে এভাবে চলে যাওয়ার সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে কেন ? প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগেও কি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিলে আমাদের পুরাণে , মহাকাব্যদ্বয়ে কি পরকীয়ার উদাহরণ আছে ? এই সব ব্যাপারগুলো যৎসামান্য জেনে নিয়ে পরকীয়া সম্পর্কে আলোচনা করব । প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক পরকীয়া বলতে সাধারণত আমরা কী বুঝি? দাম্পত্য সঙ্গী ছাড়া স্ত্রী বা স্বামী অন্য কোন বিবাহিত বা অবিবাহিত পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে দৈহিক মিলনের সম্পর্ক স্থাপিত করলে তাকে আমরা পরকীয়া বলে থাকি । বৈদিক যুগের প্রথম গ্রন্থ ঋগ্বেদ । এই বেদের ৪র্থ মণ্ডলের একটি মন্ত্র দেখা যেতে পারে । মন্ত্রটি হল, ‘ অভ্রাতরো ন যোষণো ব্যন্তঃ পতিরিপো ন জনয়ো দুরেবাঃ। / পাপসঃ সত্তো অনৃতা অসত্যা ইদং পদমজনতা গভীরম্‌।। ” ‘ ভ্রাতৃরহিতা বিপথগামিনী যোষিতের ন্যায় পতিবিদ্বেষিনী দুষ্টচারিণী ভার্যার ন্যায় , পাপী অনৃত অসত্য লোকে এ গভীর পদ উৎপাদন করেছে। ’ ৪। ৫। ৫ পতি বিদ্বেষেণী দুরাচারিণীকে পাপী বলা হয়েছে। তাহলে বোঝা গেল ঋগ্বেদের যুগেও পরকীয়া ছিল। উপনিষদে উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুর নাম পাওয়া যায়। এই শ্বেতকেতুকে নিয়ে মহাভারতের একটি কাহিনি এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করতেই হয় । কাহিনিটি এইরকম , একদিন পিতা উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতু সহ বসে রয়েছেন । এমন সময় এক ব্রাহ্মণ তাদের সামনে শ্বেতকেতুর মায়ের দৈহিক সঙ্গ কামনা করলে স্বামীর অনুমতি না নিয়েই শ্বেতকেতুর মা সেই ব্রাহ্মণের সঙ্গে চলে যান। প্রতিবাদী শ্বেতকেতুর ক্রোধ প্রশমনে উদ্দালক পুত্রকে জানান যে, স্ত্রীলোকেরা ‘ যথা গাবঃ স্থিতা স্তাত। অনাবৃতা হি সর্বেষাং বর্নানামঙ্গনাভুবি” স্ত্রীলোক গাভীর মত স্বাধীন , দেহের অধিকার তার , এটাই চিরাচরিত ধর্ম । কাজেই অন্য গমন অন্যায় নয়।
রামায়ণে রামচন্দ্রের অন্যায় ভাবে বালি হত্যার পরে পরেই তারার সুগ্রীবকে পতিত্বে বরণ পরকীয়া নয়তো ! অম্বিকা , অম্বালিকার ব্যাসের সঙ্গে পরকীয়ার ফসল ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু । এদের পুত্র পাণ্ডুর স্ত্রী কুন্তীর ভিন্ন ভিন্ন দেবতার সঙ্গে পরকীয়া জাত সন্তান যুধিষ্ঠির , ভীম, অর্জুন । আবার কুন্তীর পুত্রবধূ দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামী কী পরকীয়া নয় ! ইন্দ্র -অহল্যার পরকীয়া কাহিনী সকলেই জানে। সোম তথা চন্দ্রের সঙ্গে গুরু বৃহস্পতি পত্নী তারার পরকীয়া মহাভারতেই আছে। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের সঙ্গে সুপর্ণের স্ত্রী ঊলুপীর পরকীয়া প্রেমের ফসল পুত্র ইরবান । আয়ান ঘোষের পত্নী রাধা তার সঙ্গে কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক সর্বজন বিদিত । নারদ স্মৃতিতে নরনারীর বিবাহ পরবর্তী জীবনেও অপর নারী বা পুরুষের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মত যৌনতা অপরাধ নয় জানানো হয়েছে। কামসূত্রে পরকীয়া নিন্দনীয় নয় কিন্তু তা যদি প্রেম হীন হয় তবে তা নিন্দনীয় বলে জানানো হয়েছে।
পরবর্তীকালে শ্বেতকেতুর প্রচেষ্টায় সমাজে স্বীকৃতি পেল ,”ব্যুচ্চরন্তাঃ পতিং নার্য্যা অদ্য প্রভৃতি পাতকম্‌।’ সেই থেকে পরদার গমন পাতক হিসাবে সমাজে প্রচলিত হল । মনুসংহিতায় মনু এই প্রসঙ্গে কী বলেছেন দেখে নেওয়া যাক । তিনি বলছেন “ পরদারাভিমর্ষেষু প্রবৃত্তান ন্বৃন্‌ মহীপতিঃ ।/ উদ্বেজনকরৈর্দণ্ডৈশ্চিহ্নয়িত্বা প্রবাসয়েৎ।।” মনুসংহিতা ৮।৩৫২ । মনু রাজাকে পরস্ত্রীর দেহ সম্ভোগকারী পুরুষকে নাককান কেটে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে বলেছেন । যে সব বিবাহিত মহিলা অকারণে স্বামী ত্যাগ করে অন্যপুরুষের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হবে তাদের কী শাস্তি হবে ? মনু বলেছেন “ ভর্ত্তারং লঙ্ঘয়েদ যা তু স্ত্রী জ্ঞাতিগুণদর্পিতা ।/ তাং শ্বভিঃ খাদয়েদ্‌ রাজা সংস্থানে বহুসংস্থিতে।। ৮।৩৭১ ” যে বিবাহিতা মহিলা পড়শীর ঐশ্বর্য সমৃদ্ধি দেখে নিজের স্বামী ত্যাগ করে তার সাথে দেহ সম্ভোগে লিপ্ত হবে , তাকে নির্জন স্থানে কুকুর দিয়ে খাওয়াতে বলেছেন । আর যে পুরুষ টাকা পয়সা ধনদৌলতের গর্বে অপরের স্ত্রীকে ভোগ করবে তার কী হবে ? “ পুমাংসং দাহয়েৎ পাপং শয়নে তপ্ত আয়সে। / অভ্যাদধ্যুশ কাষ্ঠানি তত্র দহ্যেত পাপকৃত।। ৮। ৩৭২ ” সেই পরদার ভোগকারী পাপীকে আগুনে পুড়ে লাল হয়ে থাকা লোহার চিতায় শুইয়ে দিয়ে কাঠ দিয়ে তার দেহ পোড়াতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তার দেহ সম্পূর্ণ পুড়ে না যায় । “ পরদারেষু মাতৃবৎ” পরের স্ত্রীকে মাতৃসমা দেখার কথা শাস্ত্র বলেছে । আবার পরদারগামী পুরুষের মৃত্যুর পর কোন নরকে স্থান হবে তারও সুস্পষ্ট বিধান আছে শাস্ত্রে ।
একসময়ে খ্রিস্টান ধর্মে বিবাহিতের বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন ব্যভিচার হিসেবে গণ্য হত। ব্যভিচারের জন্য মৃত্যু দণ্ডের মত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাও ছিল। নোতুন নিয়মে বিবাহিতদের বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ক পাপ হলেও পাপের জন্য ব্যভিচারীর কোন শাস্তির কোন বিধান নেই। পাপ থেকে মুক্তির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার বিধান আছে।
ইসলাম ধর্মে ব্যভিচারের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। পবিত্র কোরানের সূরা এস্রায়েল আয়াত ৩২ এ ব্যভিচারের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করা হয়েছে এবং একে দুষ্কর্ম ও কুপথ বলে নির্দেশ দেওয়া আছে। সূরা নূর আয়াত ২ তে বলা হচ্ছে , “ ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী হইলে পর তাহাদের প্রত্যেককে তোমরা একশত কশাঘাত করিও । যদিও তোমরা ঈশ্বর ও পারলৌকিক বিচারের প্রতি বিশ্বাসী হও তবে ঐশ্বরীক ধর্মে তাহাদের প্রতি তোমাদের অনুগ্রহ আশ্রয় না করুক । এবং শাস্তিদান কালে এক দল বিশ্বাসী উপস্থিত থাকুক। ” কোন কোন ক্ষেত্রে শরিয়ত বিরোধী অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পাথর ছোঁড়ার ব্যবস্থাও দেখা যায় ।
রোমান সাম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রার ( খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ — খ্রিস্টপূর্ব ৩০) জুলিয়াস সিজার এবং মার্ক অ্যাণ্টনির সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক ইতিহাস খ্যাত ঘটনা । রানি ভিক্টোরিয়ার (১৮১৯ খ্রিঃ – ১৯০০ খ্রিঃ ) ও ভারতীয় দাস আবদুল করিমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কাহিনি এক সময়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ভারতে লেডি মাউন্টব্যাটনের ভারতের এক রাজনৈতিক নেতার সাথে প্রণয়ের খবর কারো অজানা নয় । পরকীয়া প্রেমে সাহিত্য জগতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত , রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর , সমরেশ বসু ইত্যাদির নাম, সংগীত ও অভিনয় জগতে ফ্লিম বা থিয়েটার , যাত্রা জগতে ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। কিন্তু কেন মানুষ পরকীয়াতে জড়িয়ে পড়ে?
বৈদিক, পৌরাণিক যুগে পরকীয়া নিয়ে যেমন বিস্তর আলোচনা হয়েছে এখনো সেই চর্চা সমানে চলছে এবং চলবেও । মনস্তাত্ত্বিক , সমাজতাত্ত্বিক এবং জীববিদ্যা বিশেষজ্ঞদের মতামত কী এ ব্যাপারে যৎসামান্য খোঁজ খবর নেওয়া যেতে পারে ।
মাইন্ডসেটের ডিরেক্টর বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবাঞ্জন পান মনে করেন নরনারীর বহুগামীতা ( Polygamous ) মানুষের আদিম অভ্যাস। আদিম মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শেখার পর সামাজিক আইন তৈরি করে । তাদের সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। মাতৃনামে সকল সন্তান পরিচিত হত। জমি ,নদী, জলের উৎস ইত্যাদির মত নারী কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না , ছিল সামাজিক সম্পত্তি ।নারী তার খুশিমত যে কোন পুরুষ সঙ্গী বেছে নিত এবং ত্যাগ করতে পারত । নারী ও পুরুষ উভয়েরই বহুগামীতা সমাজ অনুমোদন করত এবং তা দোষাবহ ছিল না । অবশ্য রমনীর ইচ্ছার প্রাধান্য সমাজের সবাই স্বীকার করত। রমনীর ইচ্ছাতেই পুরুষ তার সাথে দেহ মিলনে লিপ্ত হত। আদিম যুগ থেকে জিনের মধ্য দিয়ে মানুষ বহুগামীতার ইচ্ছা বহন কররে চলেছে।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অন্যতম হল বংশ বিস্তারের অদম্য ইচ্ছা । বায়োটেকনোলজির বিজ্ঞানীগণ খুঁজেপেতে বের করেছেন নারী- পুরুষের দৈহিক ও মানসিক আকর্ষণ মূলে আছে আমাদের দেহের অ্যাড্রিনালিন নামক একপ্রকার হরমন । এই হরমনের কমবেশি ক্ষরণের যাদুতেই পরস্পরের প্রতি জৈব তাড়না তথা লিবিডো , আকর্ষণের তীব্রতা বাড়েব কমে । অ্যাড্রিনালিন হরমন ক্ষরণের মাত্রা নির্ভর করে নরনারীর দৈহিক সক্ষমতা , ওষুধপত্রের ব্যবহার ও অপব্যবহার , জীবনযাপনের পদ্ধতি উচ্ছৃঙ্খল না সংযত , বয়স , ব্যক্তির আধ্যাত্মিক চেতনা , ধর্মীয় বিশ্বাস , নীতিবোধ ইত্যাদির উপর। সমাজ অনুমোদিত যাদের শয্যাসঙ্গী আছে তারাও কেন বিপথগামী হয় তারও কারণ অনুসন্ধান করে চলেছেন একদল গবেষক ।
অনেকে মনে করেন দাম্পত্য জীবন সাফল্যের মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে গয়না -কাপড় , টাকা -পয়সা , সাংসারিক সচ্ছলতা , মানমর্যাদা ইত্যাদির উপর নয় , নির্ভর করে পারস্পরিক বিশ্বাস ও দেহমিলন জৈবিক চাহিদার তৃপ্তির উপর। পরকীয়া সম্পর্ক স্থাপনে পুরুষের নারীকে দেহসম্ভোগে তৃপ্তি দেবার অক্ষমতা ও নারীর কামশীতলতা বহু ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার বহু ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের অতিরিক্ত দৈহিকমিলন চাহিদাও তাদের ব্যভিচারী ও বিপথগামী করে তুলে । শারীরিক অক্ষমতা , ভালোবাসাহীন দাম্পত্যজীবন , অবহেলা, বিশেষ করে পুরুষ পরকীয়াতে জড়িয়ে পড়লে প্রতিশোধ নেবার জন্য অনেক সময় স্ত্রীও পরকীয়া সম্পর্ক স্থাপন করে বসে।
মানুষ ভালোবাসার কাঙাল । কেবল দেহমিলনের আকাঙ্ক্ষা সর্বস্ব ভালোবাসাহীন দাম্পত্য জীবন নর বা নারীর জীবনে অভিশাপ স্বরূপ। এর থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য কারো কাছে নূন্যতম ভালোবাসা পেলে উভয়েই তার কাছে আত্ম সমর্পন করে বসে । আর কামগন্ধহীন প্রেম অতি দুর্লভ বস্তু শুরু হয় পরকীয়ার পথ চলা ।
বর্তমান সমাজে নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশায় কোন বাধা নেই । জীবিকার সন্ধানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবাধ প্রবেশাধিকার । বাসে ,ট্রেনে , অফিসে,শপিং মলে, হাটে -বাজারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে নরনারী । পাশাপাশি কাজ করার সুবাদে সুখ দু’খের বিনিময় হতে হতে অনেক সময় তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রচিত হয় , উভয়ের ঘর ভাঙ্গে ।
ধর্মে অবিশ্বাসীরা পরলোকে বিশ্বাস করে না । মৃত্যুর পর শাস্তির ভয়হীন নরনারী বিরক্তিকর একঘেঁয়ে শয্যাসঙ্গীর পরিবর্তে অনেক সময় চটজলদি পরিতৃপ্তি পেতে নোতুন সঙ্গী বেছে নেয় । ব্যক্তিত্ব , আমিত্ব অনেক সময়ে শিক্ষার মূল কথা যে মানিয়ে নেওয়া তা ভুলিয়ে দেয় । ছোটখাট বিষয় নিয়ে আমিত্বের সংঘাতে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে দিতে থাকে। উভয়ের ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী’ মনোভাবে সংসার কুরুক্ষেত্র সমরাঙ্গনে পরিণত হয় । জোড়াতালি দেওয়া সংন্সারের ফাঁকফোকর দিয়ে পরকীয়া প্রবেশ করে । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে পুর্বে মেয়েরা সম্পূর্ণ স্বামীর উপর নির্ভরশীল ছিল ফলে বহু ক্ষেত্রে তারা স্বামী ও তার পরিবারের অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য হত । আবার স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনা না হলেও সামাজিক মান সম্মান , কোর্ট কাচারির ভয়ে পুরুষও স্ত্রীর সঙ্গে সমঝতা করে চলত । বর্তমানে এসবকে কেউ আর তোয়াক্কা করে না । ফলে ভয় কী পরকীয়াতে ! ত্যাগ নয় , সংযমও নয়। ভোগ চাই কেবল ভোগ ।
আত্ম নির্ভরশীল হতে এবং সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে এখন স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন । কর্মক্ষেত্র এক জায়গায় না হওয়ার ফলে দূরে দূরে বসবাস করতে বাধ্য হন । এই দূরত্ব অনেক সময় উভয়ের মধ্যে মানসিক দূরত্বের সূচনা করে। এর থেকেও পরকীয়ার সূত্রপাত হয়। বর্তমানে নিজের রাজ্য ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে ভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দেন । যে অর্থ তারা সেখানে অর্জন করেন সেই অর্থের বিনিময়ে দেশে নির্ভরশীল বাবামাকে দেখা ও বাসা করে নিজের কাছে স্ত্রী পুত্রাদিকে কাছে রাখা সম্ভব হয় না । ফলে অধিকাংশকেই বিবাহিত স্ত্রীকে বাবা মায়ের কাছে রেখে দীর্ঘ দিনের জন্য ভিন্ন রাজ্যে যেতে হয় । স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার জন্য কষ্টার্জিত অর্থে স্মার্ট ফোন কিনে দিয়ে যান । প্রথম প্রথম স্বামীর সঙ্গেই আলাপ চারিতা । ছোট সংসারে অবসরের অভাব নেই । অবসর যাপনে ফোনের ব্যবহার । ক্রমে একাকীত্ব কাটাতে ফোনে নরনারীর দেহ সম্ভোগের উত্তেজনাকর দৃশ্য দেখার নিষিদ্ধ জগতে অবাধ প্রবেশ । কর্মব্যস্ত স্বামীর অবসর কম । নির্দিষ্ট সময় ছাড়া যোগাযোগ রাখতে পারেন না । এদিকে বাপের বাড়ির পূর্বতন প্রেমিক , পাড়ার লেখাপড়া জানা বেকার ঠাকুরপো বা বাড়িতে টিউশন করতে আসা যুবকটির হাতে অঢেল সময় । ঘি আগুন ও ইন্ধন পাশাপাশি থাকলে যে কোন মুহূর্তে আগুন ধরে যেতে পারে । হয়ও তাই । পুরুষের স্বাদ পাওয়া নির্ভিক বিবাহিত মহিলা , অন্য দিকে বেকার পাত্র হিসাবে মেয়ের বা মেয়ের বাবার অপছন্দের তালিকায় থাকা যুবকটির সাথে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে । চলতে থাকে পরকীয়া । অনেক সময় স্ত্রী সংসর্গ বঞ্চিত প্রবাসী স্বামীও অপরের কারো সঙ্গে জড়িয়ে যায় , ঘরের প্রতি , স্ত্রীর প্রতি টান কমে , অবহেলা বাড়ে টাকা পাঠানো দেশে আসা কমে যায় । নিরুপায় স্ত্রী অবলম্বন খোঁজে , পরপুরুষ বেছে নেয়।
বহুকাল পূর্বে কী শহর কী গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ যৌথ পরিবার ছিল । একান্নবর্তী পরিবারের নববধূটির সমবয়সী বধূ বা ননদ পাওয়া অসম্ভব ছিল না । অতি সহজে পরিবারের মধ্যে স্বামী ছাড়াও সুখ দুঃখের আদান প্রদান করার উপযুক্ত সঙ্গী জুটে যেত নবাগত বধূটির । বর্তমান প্রজন্মের মেয়েরা বাবা মায়ের একটি দুটি সন্তানের কন্যা । স্বভাবতই ভালোকরে লেখাপড়া শেখাতে চেয়ে অধিকাংশ মা মেয়েকে ঘর সংসারের কাজ থেকে দূরে রাখেন । ফলে গৃহকর্মে অনিপুণ মেয়েটির শ্বশুরবাড়িতে এসে শাশুড়িকে ঘরের কাজে সাহায্য করার দুঃসহ বোঝা কাঁধে চাপে । আর এই সংসারের কাজ নিয়েই অনেক ক্ষেত্রে নববধূর সাথে শ্বশুর শাশুড়ির মতানৈক্য ঘটতে থাকে । বাবা মায়ের ফোন বাহিত কথায়, স্ত্রীর কান্না ভেজাগলায় মতের অমিল হতে হতে সংসার সমরাঙ্গনে কুরুক্ষেত্র রচনার সলতে পাকানো শুরু হয়ে যায়। অতি বাস্তব কথা বৌমা যেমন মেয়ে হয়ে উঠতে পারে না তেমনি শাশুড়ি কখনো মা হয় না । বৌমায়ের ‘মা’ ডাক বা ‘বৌমা আমার মেয়ের মত’ বেশির ভাগ দুটোই সত্য নয় । পারিবারিক অশান্তি, সহানুভূতি হীন স্নেহ বঞ্চিত জীবন যাপন অনেক সময়ে পরকীয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন হরমন পুরুষ ও নারীর প্রাথমিক সেক্স হরমন এবং ডোপামিন এক রাসায়নিক সংযোজক যা আমাদের মাথায় থাকা স্নায়ু ও শরীরের স্নায়ু এবং পেশী কোষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে । দম্পতীর কারো এগুলোর ক্ষরণ কম হচ্ছে অথচ তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না এমন পুরুষ বা বিবাহিত স্ত্রীর জৈবিক প্রয়োজনে পরকীয়াতে জড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। । বিবাহিত নারী বা পুরুষের সমকামী প্রবণতা পরকীয়াতে আসক্ত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ ।
ঈশ্বরে বিশ্বাস , পরলোকে শাস্তির ভীতি আমাদের অধিকাংশের এখন নেই , ধর্ম আজ আচারসর্বস্ব আফিম মাত্র বা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার । শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নীতিশিক্ষা বর্জিত হয়েছে । আধুনিক ভোগবাদী নিঊক্লিয়ার ফ্যামেলিতে মানুষ হওয়া কী ছেলে কী মেয়ে চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় এই বিশ্বাস নিয়ে বড় হতে থাকে। কোন কিছুর জন্যে যে অপেক্ষা করতে হয় তা তারা শেখে না। ফলে সন্তান ধারণ ও প্রসবোত্তর স্ত্রীসংসর্গ বিরতিতে স্বামী অন্য ক্ষেত্র সন্ধানে ব্যাপৃত হয় । সঙ্গীও যায় জুটে , শুরু হয় পথ চলা । প্রোষিতভর্তৃকার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য । সন্তান দিতে অক্ষম পুরুষের স্ত্রী অনেক সময় কেবল সন্তান নেওয়ার জন্য পরপুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়।
নার্সিসিজম বা আত্মমুগ্ধতা পরকীয়া প্রেমের কারণ বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন । স্পেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক, অধ্যাপক মিগুয়েল ক্লিমিন্টের নেতৃত্বে ১৮-২৫ বছর বয়সী ৩০৮ জন নরনারীর উপর সমীক্ষা করে দেখেছেন ৭৮. ৩% মহিলা ও ২১.১% পুরুষ এই আত্মমুগ্ধতার শিকার । কিন্তু বাস্তবে ব্রিটেনে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বিবাহোত্তর জীবনে অন্য সঙ্গীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক আছে পুরুষ ১৫% এবং নারী ৯% এর ।
মিসৌরি স্টেট ইউনিভারর্সিটির প্রফেসর অ্যালিসিয়া বিশ্বব্যাপী এক সমীক্ষা চালিয়ে তার ফলাফল নিয়ে ‘ দ্য ইকোনমিক টাইম ও স্ট্যাটিস্ট ডট কম’ এ তা প্রকাশ করেন । সমীক্ষায় বিশ্বে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িত নারীপুরুষের নিরিখে দশটি দেশের তালিকা দিয়েছেন । এই এক নম্বরে থাইল্যান্ড দুইয়ে আছে ডেনমার্ক । এই তালিকায় ভারতের নাম নেই । তিনি পরকীয়া কতদিন টিকে থাকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন এবং তার পরিসংখ্যান দিয়েছেন । ৫০% পরকীয়া টিকে একবছর , ৩০% সম্পর্ক বজায় থাকে দুবছর বিবাহ পর্যন্ত গড়ায় মাত্র ৫% এর। আর বিয়ে সুখের হয় না ৯৯% এর । পরকীয়া ধরা পড়ার পর পারস্পরিক অবিশ্বাস সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয় । সমাজে দুশ্চরিত্র বা কলঙ্কিনী নাম ঘোচেনা । দুশ্চরিত্র বাবা মায়ের প্রতি সন্তানদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থকাকে না ফলে সারা জীবন তাদের কাছে অশ্রদ্ধার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এর থেকে বড় বিড়ম্বনা আর কী হতে পারে !
পরকীয়া আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় ? ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেস ডেভিস বলেন পরকীয়ার মূলে আছে আসক্তি। আর এই আসক্তির উৎস মানুষের মস্তিষ্ক স্থিত ডোপামিন নামে এক হরমনের কারিগরি । উপযুক্ত চিকিৎসকের সাহায্যে একে নিয়ন্ত্রন করা যায়। তাই পরকীয়াসক্ত মহিলা ও পুরুষের যে কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত। তিনি এর সমাধান করে দিতে পারেন । ফোনে অচেনা অজানা বা পরিচিত জনের সঙ্গেও অকারণ বেশি কথা না বলা । কেউ প্রসংশা করলে তার উদ্দেশ্য খুঁজে দেখা । বেশি রাত্রি পর্যন্ত ফোনে একা একা চোখ না রাখা । ফোনে উত্তেজেক দৃশ্য দেখা থেকে নিজেকে বিরত করা । কেউ কুপ্রস্তাব দিলে স্বামীস্ত্রী নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করে নিলে অনেক সময়ে সমস্যার থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় । সৎ কাজে নিযুক্ত থাকা , আদর্শ মানুষের জীবনী ও অন্যান্য ভালো বই পড়ার অভ্যাস করা বা সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলে পরকীয়ার আকর্ষণ থেকে মুক্ত থাকা যেতে পারে। নিয়মিত ধ্যান বা মনঃসংযোগ করার অভ্যাস করলে মন দেহ পবিত্র থাকে সহজে বিপথগামী হয় না । সন্দেহমুক্ত মন নিয়ে পরস্পরকে ভালোবাসুন , কোন কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে শিখুন , ধৈর্য ধরুন । সাময়িক জৈবিক উত্তেজনার অবৈধ পরিতৃপ্তি অপেক্ষা মানসম্মান, বিশ্বাস রক্ষা অনেক বড় ভাবত শিখলে কেউ ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না । কারো কাছ থেকে কুপ্রস্তাব এলে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করতে জানলে বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা বিন্দুমাত্র থাকবে না ।
ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডে এককালে পরকীয়া দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল । ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে চারজন বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ আই পি সির ৪৯৭ ধারা অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দিয়েছেন । তাই বর্তমান ভারতে পরকীয়া আইনত অপরাধ নয় ঠিকই কিন্তু ভারতের সমাজে নৈতিকতার বিচারে পরকীয়া আজও অপরাধ । সমাজের কেউ ব্যভিচারকে ভালো চোখে দেখে না । তবে দুঃখের বিষয় নীতি নৈতিকতা ক্রমশ আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্তির পথে হাঁটা দিয়েছে ।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!

‘স্থানীয় সংবাদ’ •ঘাটাল •পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১২১২ •ইমেল: [email protected] •হোয়াটসঅ্যাপ: 9933998177/9732738015/9932953367/ 9434243732 আমাদের এই নিউজ পোর্টালটি ছাড়াও ‘স্থানীয় সংবাদ’ নামে একটি সংবাদপত্র, MyGhatal মোবাইল অ্যাপ এবং https://www.youtube.com/SthaniyaSambad ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে।