রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক সমরসাধন চক্রবর্তীর স্মরণে অনুষ্ঠান হ’ল

বিশ্বজিৎ পণ্ডিত: রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক সমর সাধন চক্রবর্তীর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হ’ল। করোনা পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আচার্য নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরী জন্ম শতবর্ষ স্মৃতিরক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে ঘাটালের মহারাজপুর হাট মার্কেট কমপ্লেক্সে ১৮ অক্টোবর ওই অনুষ্ঠানটি হয় বলে জানান ওই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলেন,  আজকের দিনে সমরসাধনবাবুর মত মানুষ পাওয়া খুবই দুষ্কর। মহারাজপুরের ভূমিপুত্র সমরসাধনবাবু ছিলেন একাধারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবী। ১৯৯৫ সালে ১৮ অক্টোবর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শংকরদয়াল শর্মার হাত থেকে তিনি জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার  পেয়েছিলেন। সেইদিনটিকে স্মরণ করেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। প্রসঙ্গত, সমরসাধনবাবু এবছরই ৫ জুন, ৮৬ বছর বয়সে মারা যান।

শৈশবে তীব্র দারিদ্রতা সত্ত্বেও তিনি শিক্ষার পথ থেকে সরে আসেননি সমরসাধনবাবু। কখনও ম্যাজিকের কাজ শিখে ম্যাজিক দেখিয়ে,  কখনও লেবারদের দেখাশোনার জন্য উড়িষ্যায় গিয়ে জীবনযাপন করেছেন তিনি। একসময় শারীরিক অসুস্থতার কারণে নাগা সন্ন্যাসীর জীবন-যাপনেও অভ্যস্ত হয়ে যান আসামের উমাচল আশ্রমে, যেখানে তাকে জঙ্গলেও দিন অতিবাহিত করতে হয়েছিল।

সমরসাধনবাবুকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার  পেছনে অবদান রয়েছে প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী, সাংসদ আচার্য নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরির। ওই সময় অভিনেতা হওয়ার জন্য ইন্দ্রপুরী  স্টুডিওতে যান তিনি, কিন্তু হয়ে যান মেকআপম্যান। ওই সময় তিনি যুগবাণী পত্রিকায় লেখার সুযোগ পান।  কলকাতার আকাশবাণীতে নিয়মিত প্রাত্যহিকীতে লেখা পাঠাতেন তিনি। যা বহুল প্রচারিত হত। সু-স্বাগতম চোদ্দশ শতক লেখাটি আকাশবাণী হতে বহুল প্রচারিত হয়েছিল, সাথে সাথে তিনি চণ্ডীপাঠের কাজ করতেন। তবুও অভিনেতা হবার বাসনা মনকে উতলা করে তুলত।  একদিন অভিনেতা হতে না পারার ব্যর্থ মনোরথে  হাওড়া ব্রিজে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখা হয় আচার্য নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরির সাথে।  তাঁর শাসনে ও সুপরামর্শে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিতে তিনি বাধ্য হন।  হয়ে যান তিনি শিক্ষক। প্রথমে ১৯৬২তে পার্বতীচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ১৯৬৫তে  বাড়আনন্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ১৯৮০তে মালঞ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ৮২তে নারায়ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ৯৩-এ  বাণেশ্বরমন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন তিনি।  শিক্ষাবিতরণে তাঁর ভূমিকায় ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মার হাত থেকে জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার পান। এই সময় তিনি চন্ডী পাঠকেরও পুরস্কার পান।  এরপর বেশ কয়েকটি রাজ্যে সম্মানিত হন এবং বিদেশ তথা দুবাই থেকেও একাধিক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯-এ তাঁর শিক্ষকতা জীবনের অবসান ঘটে।

অবসর জীবনের পূর্ব থেকেই তিনি বিবিধ শিক্ষা প্রসঙ্গে বই লিখে গেছেন স্বনামে এবং ছদ্মনামে।  তাঁর লিখিত বই ‘ডাটা কালেক্ট টুল’ (৫টি খণ্ড) যা প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসে অনবদ্য দলিল ও সমাজ সেবা শিক্ষা প্রসঙ্গে ক্রমোদভিন্ন চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে।

১৯৬২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বিবিধ বিষয়ের প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি। অ্যাডাল্ট এডুকেশন, প্রাথমিক শিক্ষক, নন ফরমাল এডুকেশন, ইউনিসেফ পরিচালিত আনন্দপাঠ, শিশুশিক্ষার, বছরভিত্তিক পরিকল্পনার সর্বশিক্ষা অভিযান, বিভিন্ন বিষয়ের প্রশিক্ষকের ভূমিকা তিনি দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন। তাঁর সুপারিশক্রমে পশ্চিমবঙ্গ সরকার চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের চিন্তাভাবনা শুরু করেন যা বর্তমানে সরকারি ভাবে কার্যকরী হয়েছে।

তিনি রাজনৈতিক কর্মেও যুক্ত ছিলেন সাথে সাথে সমাজ সেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি কারো সাথে দেখা হলে জানতে চাইতেন জনগণ কেমন আছে অর্থাৎ পরিচিতরা সব কেমন আছেন। এই ভাবে সর্বস্তরের মানুষের তিনি আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন।

আমরা পেয়েছিলাম একজন প্রকৃত মানুষ, প্রকৃত শিক্ষককে।  তিনি ছিলেন শিক্ষকের শিক্ষক।  এনার দেওয়া শিক্ষা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী প্রজন্ম এগিয়ে চলবে।

প্রসঙ্গত, এদিনের স্মরণসভায়  সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অশোক জানা, প্রধান অতিথি সুবলচন্দ্র ঘোড়ই, বিশেষ অতিথি দেবাশিস মাইতি ও সুভাষচন্দ্র দত্ত, ড. বিকাশচন্দ্র হাজরা, কানাইলাল পাখিরা, স্বপন ভট্টাচার্য, সমরবাবুর পরিবারের সদস্যরা, সহধর্মিনী বাসন্তী চক্রবর্তী প্রমুখ।  অনুষ্ঠানের শুরুতে এলাকার প্রাক্তন শিক্ষক ও বর্তমান শিক্ষক এবং এলাকার গুণীজনদের  সংবর্ধিত করা হয়।

ঘাটাল মহকুমার সমস্ত আপডেট তে যুক্ত হন আমাদের সাথে!